শ্রীভগবানুবাচ –
পরং ভূয়ঃ প্রবক্ষ্যামি জ্ঞানানাং জ্ঞানমুত্তমম্।
যজ্ জ্ঞাত্বা মুনয়ঃ সর্ব্বে পরাং
সিদ্ধিমিতো গতাঃ।।১
অর্থঃ-(১) শ্রীভগবান্ কহিলেন,- আমি পুনরায় জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্ব্বোত্তম
জ্ঞান বলিতেছি, যাহা জানিয়া মুনিগণ এই দেহবন্ধন হইতে মোক্ষ লাভ করিয়াছেন।
পূর্ব্ব অধ্যায়ে বলা হইয়াছে, সকল কর্ত্তৃত্বই প্রকৃতির, পুরুষ অকর্ত্তা।
প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের সদসদ্যোনিতে জন্ম ও সুখদুঃখ ভোগ অর্থাৎ সংসারিত্ব।
এই গুণ কি কি, উহাদের লক্ষণ কি, উহারা কি ভাবে জীবকে আবদ্ধ করে্ কিরূপে প্রকৃতি
হইতে বিবিধ সৃষ্টি হয়, ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিত কিছুই বলা হয় নাই। সেই হেতু এই
প্রকৃতিতত্ত্ব বা ত্রিগুণ তত্ত্বই আবার বলিতেছেন। এই হেতুই 'ভূয়ঃ' অর্থাৎ পুনরায় শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে।
ইদং জ্ঞানমুপাশ্রিত্য মম সাধর্ম্ম্যমাগতাঃ।
সর্গেহপি নোপজায়ন্তে প্রলয়ে ন
ব্যথন্তি চ।।২
সাধর্ম্ম্য – স্বরূপতা
অর্থাৎ আমি যেমন ত্রিগুণাতীত এইরূপ ত্রিগুণাতীত অবস্থা।
অর্থঃ-(২) এই জ্ঞান আশ্রয় করিয়া যাহারা আমার সাধর্ম্ম্য লাভ করেন অর্থাৎ
ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন, তাঁহারা সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও
ব্যথিত হন না (অর্থাৎ জন্মমৃত্যু অতিক্রম করেন)।
মম যোনির্মহদ্ ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ভং
দধাম্যহম্।
সম্ভবঃ সর্ব্বতভূতানাং ততো ভবতি
ভারত।।৩
অর্থঃ-(৩) হে ভারত, প্রকৃতিই আমার গর্ভাধান-স্থান। আমি তাহাতে গর্ভাধান
করি, তাহা হইতেই সর্ব্বভূতের উৎপত্তি হয়।
সর্ব্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্ত্তয়ঃ
সম্ভবন্তি যাঃ।
তাসাং ব্রহ্ম মহদ্ যোনিরহং বীজপ্রদঃ
পিতা।।৪
মহদ্ব্রহ্ম – অর্থ
প্রকৃতি; 'গর্ভাধন করি' অর্থ এই – সর্ব্বভূতের জন্মকারণ স্বরূপ বীজ প্রকৃতিরূপ যোনিতে আধান করি। তাৎপর্য্য
এই যে, ভূতগণকে তাহাদের স্বীয় প্রাক্তন কর্ম্মানুরূপ ক্ষেত্রের সহিত সংযোজিত করি।
এই সংযোজনই গর্ভাধান। অথবা প্রকৃতিতে আমার সংকল্পিত বীজ আধান করি অর্থাৎ আমার
সংকল্পানুসারেই প্রকৃতি সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে, ঈশ্বরের সৃষ্টি-সঙ্কল্পই
গর্ভাধানস্বরূপ। প্রকৃতির স্বতন্ত্র সৃষ্টি-সামর্থ্য নাই।
অর্থঃ-(৪) হে কৌন্তেয়,
দেবমনুষ্যাদি বিভিন্ন যোনিতে যে সকল শরীর উৎপন্ন হয়, প্রকৃতি তাহাদের মাতৃস্থানীয়া
এবং আমিই গর্ভাধানকর্ত্তা পিতা।
এই গর্ভাধান
কি তাহা পূর্ব শ্লোকে বলা হইয়াছে। বেদান্তে ইহাকেই ঈক্ষণ বলে।
সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ
প্রকৃতিসম্ভবাঃ।
নিভধ্নন্তি মহাবাহো দেহে
দেহিনমব্যয়ম্।।৫
অর্থঃ-(৫) হে মহাবাহো, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, প্রকৃতিজাত এই গুণত্রয় দেহমধ্যে
অব্যয় আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে।
জীবাত্মা অবিকারী হইলেও প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃ দেহাত্মভাব প্রাপ্ত হওয়ার
সুখ-দুঃখ মোহাদিতে জড়িত হইয়া পড়েন। ৫।৬।৭।৮ এই চারিটি শ্লোকে ত্রিগুণের বন্ধ
অর্থাৎ প্রকৃতি-সংযোগে পুরুষের সংসারবন্ধন বর্ণনা হইতেছে।
তত্র সত্ত্বং নির্ম্মলত্বাৎ
প্রকাশকমনাময়ম্।
সুখসঙ্গেন বধ্নাতি জ্ঞানসঙ্গেন
চানঘ।।৬
অর্থঃ-(৬) হে অনদ, এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্ম্মল বলিয়া প্রকাশক
এবং নির্দ্দোষ; এই সত্ত্বগুণ সুখসঙ্গ ও জ্ঞানসঙ্গ-দ্বারা আত্মাকে বন্ধন করিয়া
রাখে।
সত্ত্বগুণের বন্ধন কিরূপ – সত্ত্বগুণের মুখ্য ধর্ম্ম দুইটি, সুখ ও জ্ঞান। এই সুখ ও জ্ঞানকেও বন্ধনের
কারণ বলা হইতেছে। এই সুখ বলিতে আত্মানন্দ বুঝায় না। সুখ-দুঃখাদি ক্ষেত্রের ধর্ম্ম,
দেহ-ধর্ম্ম, উহা আত্মার ধর্ম্ম নহে, সুতরাং অবিদ্যা (১৩।৬) – (ইচ্ছাদি ধৃত্যন্তং ক্ষেত্রস্যৈব
বিবরস্য ধর্ম্ম ইত্যুক্তং ভগবতে সৈয্য অবিদ্যা – শঙ্কর); আর এই জ্ঞান, আত্মজ্ঞান নহে। বস্তুতঃ
সত্ত্বগুণের দ্বিবিধ প্রকারভেদ আছে – (১) মিশ্রসত্ত্ব অর্থাৎ রজস্তমো মিশ্রিত সত্ত্ব এবং (২) শুদ্ধ সত্ত্ব
অর্থাৎ রজন্তমোবর্জিত সত্ত্ব। এস্থলে সত্ত্বাদি তিনটি গুণের পৃথক্ পৃথক্ লক্ষণ
বর্ণিত হইলেও উহারা পৃথক্ থাকে না, সর্ব্বদা এক সঙ্গেই থাকে, এই এক সঙ্গে থাকা
কালে অপর দুইটিকে অভিভূত করিয়া সত্ত্বগুণ প্রবল হইলে যে লক্ষণ উপস্থিত হয় উহাই
মিশ্র সত্ত্বের লক্ষণ। উহা উচ্চ অবস্থা হইলেও মোক্ষদায়ক নহে, কেননা উহাতে রজঃ ও
তমঃ মিশ্রিত থাকায় 'আমি জ্ঞানী' ইত্যাদি আত্মাভিমান থাকে, উহাও ত্রৈগুণ্যের অবস্থা, মোক্ষের অবস্থা
নহে।
ত্রিগুণের বর্ণনায় অবশ্য তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক – এই ত্রিবিধ অবস্থাই পৃথক্ ভাবে
বর্ণনা করিতে হয় – এ সকলই
বদ্ধাবস্থা, ইহার অতীত ত্রিগুণাতীত অবস্থাই মোক্ষাবস্থা। শ্রীভাগবতে এই হেতুই
ভক্তিতত্ত্ববর্ণন-প্রসঙ্গে তামসিক, রাজসিক, সাত্মিক এই ত্রিবিধ ভক্তির লক্ষণ
বর্ণনা করিয়া পরে নির্গুণা ভক্তির বর্ণনা করা হইয়াছে এবং সে স্থলে ইহাও বলা হইয়াছে
যে এই নির্গুণ ভক্তির উৎকর্ষাবস্থায় ভেদজ্ঞান বিদূরিত হয়, তখন ত্রিগুণ অতিক্রম
করিয়া জীব ভাগবত জীবন বা ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয় - 'যেনাতিব্রজ্য ত্রিগুণং মদ্ভাবায়োপপদ্যতে'(ভাঃ ৩।২৯।৭ – ১৪)। সেইরূপ গীতাতেও তমঃ রজঃ, সত্ত্ব এই ত্রিগুণকে পৃথক্ভাবে বন্ধনের
কারণ বলিয়া পরে অধ্যায়ের শেষে ত্রিগুণাতীত অবস্থার বর্ণনায় অহৈতুকী নির্গুণা
ভক্তিদ্বারাই ব্রহ্মভাব লাভ হয় – এই কথাই বলা হইয়াছে। কিন্তু গীতাতে
অনেক স্থলেই বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের অবস্থাকেই ত্রিগুণাতীত অবস্থা বলিয়া গ্রহণ করা
হইয়াছে, যেমন ১৮।২০ শ্লোকে সাত্ত্বিক জ্ঞানের যে বর্ণনা উহা প্রকৃতপক্ষে
সিদ্ধাবস্থার বর্ণনা। বস্তুতঃ ত্রিগুণাতীতের অবস্থার যে লক্ষণ উহাই
রজস্তমোবর্জ্জিত বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের লক্ষণ এবং উহাই হইতেছে বির্দ্বন্দ্বভাব, বিমল
সদানন্দ এবং অপরোক্ষ আত্মানুভূতির অবস্থা। গীতায় নিস্ত্রৈগুণ্য বা ত্রিগুণাতীত
বলিতে 'নিত্য শুদ্ধসত্ত্বগুণাশ্রিত'বুঝায়, এই হেতুই ২।৪৫ শ্লোকে শ্রীভগবান্
অর্জ্জুনকে 'নিস্ত্রৈগুণ্য' হইতে বলিয়াও 'নিত্যসত্ত্বস্থ'
হইতে বলিয়াছেন। পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি অনুধাবন করিলেই একই সত্ত্বগুণকে অনেক স্থলেই
মোক্ষের কারণ এবং ১৪।৬ শ্লোকে বন্ধনের কারণ কেন বলা হইতেছে তাহা বুঝা যাইবে।
শ্রীমৎ
শঙ্করাচার্য্য 'বিবেকচুড়ামণি'তে এই দ্বিবিধ সত্ত্বগুণের লক্ষণ ও পার্থক্য স্পষ্ট
উল্লেখ করিয়াছেন। যথা, শুদ্ধ সত্ত্বের লক্ষণ –
বিশুদ্ধসত্ত্বস্য গুণাঃ প্রসাদঃ
স্বাত্মানুভূতিঃ পরমা প্রশান্তিঃ।
তৃপ্তিঃ প্রহর্ষ:
পরমাত্মনিষ্ঠা যয়া সদানন্দরসং সমৃচ্ছতি।।
এ শ্লোকের মর্ম্ম এই যে বিশুদ্ধ সত্ত্বের ধর্ম্ম দুইটি – (১) আত্মজ্ঞান (আত্মানুভূতি,
পরমাত্মনিষ্ঠা); (২) আত্মানন্দ (প্রসাদ, প্রশান্তি, তৃপ্তি, প্রহর্ষ সদানন্দ)।
মিশ্রসত্ত্বের লক্ষণ –
'সত্ত্বং বিশুদ্ধং জলবৎ তথাপি
তাভ্যাং
মিলিত্বা সরণায় কল্পতে।'
'মিশ্রস্য
সত্ত্বস্য ভবন্তি ধর্মাঃ স্বমানিতাদ্যা নিয়মা যমাদ্যাঃ
শ্রদ্ধা চ
ভক্তিশ্চ মুমুক্ষতা চ দৈবী চ সম্পত্তরসন্নিবৃত্তঃ।।'
এ কথার মর্ম্ম এই যে – সত্ত্বগুণ জলের ন্যায় নির্ম্মল হইলেও অপর দুইটির সহিত মিশ্রিত থাকায় উহা
বন্ধনের কারণ হয়। এইরূপ মিশ্র সত্ত্বের লক্ষণ – কর্ত্তৃত্বাভিমান, যমনিয়মাদি, শ্রদ্ধা, ভক্তি,
মুমুক্ষুতা, শমদমাদি দৈবী সম্পদ্ অনিত্য বস্তুতে বিরাগ। মূল কথা এই – মিশ্রসত্ত্ব মুমুক্ষুর সাধনাবস্থার
লক্ষণ; শুদ্ধসত্ত্ব, মুক্তের সিদ্ধাবস্থার লক্ষণ।
"সত্ত্বগুণের খুব প্রাধান্য হইলেও তাহা প্রকৃত স্বাধীনতার অবস্থা নহে
(উহাও বন্ধনের অবস্থা)। কারণ গীতা দেখাইয়াছেন যে অন্যান্য গুণের ন্যায় সত্ত্বও
বন্ধন করে এবং অন্যান্য গুণের ন্যায়ই বাসনা ও অহঙ্কারের দ্বারাই বন্ধন করে।
সত্ত্বের বাসনা মুত্তর, সত্ত্বের অহঙ্কার শুদ্ধতর, কিন্তু যতদিন এই দুইটি – বাসনা ও অহঙ্কার – যে কোন আকারে জীবকে ধরিয়া থাকে,
ততদিন কোন স্বাধীনতা নাই। যে মানুষ সাধু, জ্ঞানী, তাঁহার ভিতর সাধুর 'অহং' রহিয়াছে এবং তিনি এই
সাত্ত্বিক অহঙ্কারের তৃপ্তি করিতে চান। প্রকৃত স্বাধীনতা, চরম স্বরাজ্য তখন আরম্ভ
হইবে যখন প্রাকৃত আত্মার উপরে আমরা পরমাত্মাকে দেখিতে পাইব, ধরিতে পারিব; আমাদের
ক্ষুদ্র 'আমি' – আমাদের অহঙ্কার এই পরমাত্মাকে দেখিতে দেয় আন। ইহার জন্য
আমাদিগকে গুণত্রয়ের বহু ঊর্দ্ধে উঠিতে হইবে, ত্রিগুণাতীত হইতে হইবে, কারণ পরমাত্মা
সত্ত্বগুনেরও উপরে। আমাদিগকে সত্ত্বের ভিতর দিয়াই উঠিতে হইবে বটে, কিন্তু যতক্ষণ
আমরা সত্ত্বকে ছাড়াইয়া যাইব ততকশণ সেখানে পৌঁছিতে পারিব না। কেবল তখনই আমরা
নিশ্চিন্ত হইয়া তাঁহাতে বাস করিতে পারি যখন আমাদের সমস্ত বাসনা দূর হইয়া গিয়াছে।"
– শ্রীঅরবিন্দের গীতা (অনিলবরণ)।
রজো রাগাত্মকং বিদ্ধি
তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্।
তন্নিবধ্নাতি কৌন্তেয় কর্ম্মসঙ্গেন
দেহিনম্।।৭
তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবং – তৃষ্ণা অপ্রাপ্তেহর্ষহভিলাষঃ সঙ্গঃ প্রাপ্তেহর্থে প্রীতি তয়োঃ সমুদ্ভবো
যস্মাৎ তৎ (শ্রীধর) – তৃষ্ণা – অপ্রাপ্ত বস্তুতে অভিলাষ; সঙ্গ – প্রাপ্ত বস্তুতে প্রীতি বা আসক্তি,
এই উভয় যাহা হইতে উৎপন্ন হয়।
অর্থঃ-(৭) হে অর্জ্জুন, রজোগুণ রাগাত্মক; তৃষ্ণা ও আসক্তি উহা হইতে উৎপন্ন
হয়। উহা কর্ম্মশক্তি দ্বারা দেহীকে বন্ধন করে।
তমস্ত্বজ্ঞানজং বিদ্ধি মোহনং
সর্ব্বদেহিনাম্।
প্রমাদালস্যনিদ্রাভিস্তন্নিবধ্নাতি
ভারত।।৮
অর্থঃ-(৮) হে ভারত, তমোগুণ অজ্ঞানজাত এবং দেহীগণের ভ্রান্তিজনক। ইহা প্রমাদ
(অনবধানতা), আলস্য ও নিদ্রা (চিত্তের অবসাদ) দ্বারা জীবনকে আবদ্ধ করে।
সত্ত্বং সুখে সঞ্জয়তি রজঃ কর্ম্মণি
ভারত।
জ্ঞানমাবৃত্য তু তমঃ প্রমাদে
সঞ্জয়ত্যুত।।৯
অর্থঃ-(৯) হে ভারত, সত্ত্বগুণ সুখে এবং রজোগুণ কর্ম্মে জীবকে আসক্ত করে। কিন্তু
তমোগুণ জ্ঞানকে আবৃত করিয়া প্রমাদ (কর্ত্তব্যমূঢ়তা বা অনবধাবতা) উৎপন্ন করে।
রজস্তমশ্চাভিভূয় সত্ত্বং ভবতি ভারত।
রজঃ সত্ত্বং তমশ্চৈব তমঃ সত্ত্বং
রজস্তথা।।১০
অর্থঃ-(১০) হে ভারত, সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়,
রজোগুণ তমঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এবং তমোগুণ রজঃ ও সত্ত্বগুণকে
অভিভূত করিয়া প্রবল হয়।
এই তিন গুণ কখনো পৃথক্ পৃথক্ থাকে না, তিনটি একত্রই থাকে। কিন্তু জীবের
পূর্ব্ব কর্ম্মানুরূপ অদৃষ্টবশে কখনও সত্ত্বগুণ অপর দুইটিকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়
এবং জীবকে সুখাদিতে আসক্ত করে। এইরূপ কোথাও রজোগুণ প্রবল হইয়া কর্ম্মাসক্তি জন্মায়
বা তমোগুণ প্রবল হইয়া নিদ্রা, প্রমাদ, আলস্যাদি উৎপন্ন করে। এই হেতুই বিভিন্ন
জীবের সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এইরূপ বিভিন্ন প্রকৃতি দৃষ্ট হয়।
এই কয়েকটি শ্লোকে (১০ম-১৩শ) সাত্ত্বিক, রাজস ও তামস এই ত্রিবিধ স্বভাবের
লক্ষণ – বলা হইতেছে।
সর্ব্বদ্বারেষু দেহেহস্মিন্ প্রকাশ
উপজায়তে।
জ্ঞানং যদা তদা বিদ্যাদ্ বিবৃদ্ধিং
সত্ত্বমিত্যুত।।১১
অর্থঃ-(১১) যখনই এই দেহে শ্রোত্রাদি সর্ব্ব ইন্দ্রিয়দ্বারে জ্ঞানাত্মক
প্রকাশ অর্থাৎ নির্ম্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তখন জানিবে যে সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত
হইয়াছে।
এস্থলে 'উত'
শব্দদ্বারা সুখাদি লক্ষণও বুঝিতে হইবে।
লোভঃ প্রবৃত্তিরারন্মঃ কর্ম্মণামশমঃ
স্পৃহা।
রজস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে
ভরতর্ষভ।।১২
তাশমঃ – অশান্তিঃ, অতৃপ্তি; সর্ব্বদা ইহা
করিয়া উহা করিব – ইত্যাদি রূপ
অস্থিরতা।
অর্থঃ-(১২) হে ভরতশ্রেষ্ঠ, লোভ, সর্ব্বদা কর্ম্মে প্রবৃত্তি এবং সর্ব্ব
কর্ম্মে উদ্যম, শান্তি ও তৃপ্তির অভাব, বিষয়স্পৃহা – এই সকল লক্ষণ রজোগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে উৎপন্ন হয়।
অপ্রকাশোহপ্রবৃত্তিশ্চ প্রমাদো মোহ এব
চ।
তমস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে
কুরুনন্দন।।১৩
অর্থঃ-(১৩) হে কুরুনন্দন, তমোগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে বিবেক-ভ্রংশ,
নিরুদ্যমতা, কর্ত্তব্যের বিস্মরণ এবং মোহ বা বুদ্দি-বিপর্য্যয় – এই সকল লক্ষণ উৎপন্ন হয়।
যদা সত্ত্বে প্রবৃদ্ধে তু প্রলয়ং যাতি
দেহভূৎ।
তদোত্তমবিদাং লোকানমলান্
প্রতিপদ্যতে।।১৪
অর্থঃ-(১৪) সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে যদি জীবের মৃত্যু হয়, তবে তিনি
তত্ত্ববিদ্গণের প্রাপ্য প্রকাশময় দিব্য লোকসকল প্রাপ্ত হন।
উত্তমবিদাং – উত্তমবিদ্গণের
অর্থাৎ মহদাদি-তত্ত্ববিদ্গণের (শঙ্কর); হিরণ্যগর্ভাদির উপাসকগণের (শ্রীধর); উত্তম
তত্ত্ব-জ্ঞানীদিগের অর্থাৎ দেবতা প্রভৃতির (তিলক)।
রজসি প্রলয়ং গত্বা কর্ম্মসঙ্গিষু
জায়তে।
তথা প্রলীনস্তমসি মূঢ়যোনিষু জায়তে।।১৫
অর্থঃ-(১৫) রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে কর্ম্মাসক্ত মনুষ্য-যোনিতে
জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে পশ্বাদি মূঢ় যোনিতে জন্ম হয়।
কর্ম্মণঃ সুকৃতস্যাহুঃ সাত্ত্বিকং
নির্ম্মলং ফলম্।
রজসস্তু ফলং দুঃখমজ্ঞানং তমসঃ
ফলম্।।১৬
অর্থঃ-(১৬) সাত্ত্বিক পুণ্য কর্ম্মের ফল নির্ম্মল সুখ, রাজসিক কর্ম্মের ফল
দুঃখ এবং তামসিক কর্ম্মের ফল অজ্ঞান, এইরূপ তত্ত্বদর্শিগণ বলিয়া থাকেন।
সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং রজসো লোভ
এবচ।
প্রমাদমোহৌ তমসো ভবতোহজ্ঞানমেব চ।।১৭
অর্থঃ-(১৭) সত্ত্বগুণ হইতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়; এবং রজোগুণ হইতে লোভ এবং
তমোগুণ হইতে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হইয়া থাকে।
ঊর্দ্ধং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা মধ্যে
তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ।
জঘন্যগুণবৃত্তিস্থা অধো গচ্ছন্তি
তামসাঃ।।১৮
জঘন্যগুণবৃত্তিস্থাঃ – জঘন্যো নিকৃষ্টঃ তমোগুণঃ তস্য বৃত্তঃ প্রমাদমোহাদিঃ তত্র স্থিতাঃ
(শ্রীধর)।
অর্থঃ-(১৮) সত্ত্বগুণপ্রধান ব্যক্তি ঊর্দ্ধলোকে অর্থাৎ স্বর্গাদি লোকে গমন
করেন; রজঃ প্রধান ব্যক্তিগণ মধ্যলোকে অর্থাৎ ভূলোকে অবস্থান করেন; এবং প্রমাদ
মোহাদি নিকৃষ্টগুণ-সম্পন্ন তমঃপ্রধান ব্যক্তিগণ অধোগামী হয় (তামিস্রাদি নরক বা
পশ্বাদি যোনি প্রাপ্ত হয়)।
নান্যং গুণেভ্যঃ কর্ত্তারং যদা
দ্রষ্টানুপশ্যতি।
গুণেভ্যশ্চ পরং বেত্তি মদ্ভাবং
সোহধিগচ্ছতি।।১৯
অর্থঃ-(১৯) যখন দ্রষ্টা জীব, গুণ ভিন্ন অন্য কাহাকেও কর্তা না দেখেন
(অর্থাৎ প্রকৃতিই কর্ম করে, আমি করি না, ইহা বুঝিতে পারেন) এবং ত্রিগুণের অতীত পরম
বস্তুকে অর্থাৎ আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন আমার ভাব অর্থাৎ ব্রহ্মভাব বা ত্রিগুণাতীত
অবস্থা প্রাপ্ত হন।
গুণানেতানতীত্য ত্রীন্ দেহী
দেহসমুদ্ভবান্।
জন্মমৃত্যুজরাদুঃখৈর্বিমুক্তোহমৃতমশ্নুতে।।২০
দেহ-সমুদ্ভবান্ - দেহঃ সমুদ্ভবঃ পরিণামো যেষাং তান্
দেহোৎপত্তিবীজভূতানিত্যর্থঃ (শ্রীধর)।
অর্থঃ-(২০) জীব দেহোৎপত্তির কারণভূত এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া
জন্মমৃত্যুজরাদুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া অমৃতত্ব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন।
প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের দেহোৎপত্তি ও সংসারিত্ব। এই ত্রিগুণ অতিক্রম
করিতে পারিলেই মোক্ষ। তাহার উপায় কি? সাংখ্য দর্শন বলেন যে, জীব যখন বুঝিতে পারে
যে প্রকৃত পৃথক, আমি পৃথক, তখনই তাহার মুক্তি হয়। কিন্তু বেদান্ত ও গীতা সাংখ্যের
এই প্রকৃতি-পুরুষরূপী দ্বৈতকে মূল তত্ত্ব বলিয়া স্বীকার করেন না। সুতরাং এই কথাটিই
গীতায় এইরূপ ভাবে বলা হয় যে, প্রকৃতি ও পুরুষের উপরে যে পরমাত্মা বা পুরুষোত্তম
আছেন, সেই পরমাত্মাকে যখন জীব জানিতে পারে তখনই তাহার মোক্ষ বা ব্রহ্মভাব লাভ হয়।
অর্জ্জুন উবাচ –
কৈর্লিঙ্গৈর্স্ত্রিন্ গুণানেতানতীতো
ভবতি প্রভো।
কিমাচারঃ কথং চৈতাংস্ত্রীন্
গুণানতিবর্ত্ততে।।২১
অর্থঃ-(২১) অর্জুন কহিলেন, - হে প্রভো, কোন্ লক্ষণের দ্বারা জানা যায় যে
জীব ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়াছেন? তাহার আচার কিরূপ? এবং কি প্রকারে তিনি ত্রিগুণ
অতিক্রম করেন।
পূর্ব্ব শ্লোকে বলা হইয়াছে যে ত্রিগুণাতীত হইলেই মোক্ষ লাভ হয়। এক্ষণে
অর্জ্জুন জানিতে চাহিতেছেন যে, ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ কি এবং ত্রিগুণাতীত হওয়ার উপায়
কি? দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞ সন্বন্ধেও এইরূপ প্রশ্ন করিয়াছিলেন (২।৫৪) এই
স্থিতপ্রজ্ঞ এবং ত্রিগুণাতীতের অবস্থা একই। ইহাকেই ব্রহ্মীস্থিতি বলে।
শ্রীভগবানুবাচ –
প্রকাশঞ্চ প্রবৃত্তিঞ্চ মোহমেব চ
পাণ্ডব।
ন দ্বেষ্টি সংপ্রবৃত্তানি ন
নিবৃত্তানি কাঙ্ক্ষতি।।২২
অর্থঃ-(২২) শ্রীভগবান্ বলিলেন, - হে পাণ্ডব, সত্ত্বগুণের কার্য্য প্রকাশ
বা জ্ঞান, রজোগুণের ধর্ম্ম-কর্ম্ম-প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের ধর্ম্ম মোহ, এই সকল
গুণধর্ম্ম প্রবৃদ্ধি হইলেও যিনি দুঃখবুদ্ধিতে দ্বেষ করেন না এবং ঐ সকল কার্য্য
নিবৃত্ত থাকিলে যিনি সুখবুদ্ধিতে উহা আকাঙ্খা করেন না, তিনিই গুণাতীত বলিয়া উক্ত
হন।
তাৎপর্য – এই যে, দেহে
প্রকৃতির কার্য্য চলিচেছে চলুক। আমি উহাতে লিপ্ত নই। আমি অকর্ত্তা, উদাসীন,
সাক্ষিস্বরূপ। এই জ্ঞান যাঁহার হইয়াছে তিনিই ত্রিগুণাতীত। দেহ থাকিতে ত্রিগুণের
কার্য্য চলিবেই, কিন্তু দেহী যখন ইহাতে লিপ্ত হন না, তখনই তিনি ত্রিগুণাতীত হন।
উদাসীনবদাসীনো গুণৈর্যো ন বিচাল্যতে।
গুণা বর্ত্তন্ত ইত্যেব যোহবতিষ্ঠতি
নেঙ্গতে।।২৩
অর্থঃ-(২৩) যিনি উদাসীনের ন্যায় সাক্ষীস্বরূপ অবস্থান করেন, সত্ত্বাদিগুণকার্য্য
সুখ-দুঃখাদি কর্ত্তৃক বিচলিত হন না, গুণ সকল স্ব স্ব কার্য্যে বর্ত্তমান আছে, আমার
সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই, ইহা মনে করিয়া যিনি চঞ্চল হন না, তিনি গুণাতীত বলিয়া
কথিত হন।
সমদুঃখসুখঃ স্বস্থঃ
সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ।
তুল্যপ্রিয়াপ্রিয়ো
ধীরস্তুল্যনিন্দাত্মসংস্তুতিঃ।।২৪
অর্থঃ-(২৪) যাহার নিকট সুখদুঃখ সমান, যিনি স্ব-স্ব অর্থাৎ আত্মস্বরূপেই
স্থিত, মৃত্তকা, প্রস্তর ও সুবর্ণ যাহার নিকট সমান, যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় এবং আপনার
নিন্দা ও প্রশংসা তুল্য মনে করেন, যিনি ধীমান্ বা ধৈর্য্যযুক্ত, তিনিই গুণাতীত
বলিয়া অভিহিত হন।
মানাপমানয়োস্তুল্যস্তুল্যো
মিত্রারিপক্ষয়োঃ।
সর্ব্বারম্ভপরিত্যাগী গুণাতীতঃ স
উচ্যতে।।২৫
অর্থঃ-(২৫) মান ও অপমানে, শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষে যাঁহার তুল্য জ্ঞান এবং
ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া যিনি কোন কর্ম্মোদ্যম করেন আন, এরূপ ব্যক্তি গুণাতীত বলিয়া কথিত
হন।
ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ – ২১শ-২৫শ শ্লোকে ত্রিগুণাতীত পুরুষের লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে। দেহে গুণের
কার্য্য চলিতে থাকিল যিনি উদাসীনের ন্যায় স্বাক্ষিস্বরূপে অবস্থিত থাকেন, গুণকার্য
সুখদুঃখ মোহাদি কর্ত্তৃক বিচলিত হন না, তিনিই ত্রিগুণাতীত; তিনি নির্দ্বন্দ্ব,
নিঃসঙ্গ, সর্ব্বত্র সমবুদ্ধিসম্পন্ন। সাংখ্যের পরিভাষায় যাহা ত্রিগুণাত্মিকা
প্রকৃত, বেদান্তের ভাষায় তাহাই অজ্ঞান বা মায়া। সুতরাং ত্রিগুণাতীত অবস্থাই হইতেছে
মায়ামুক্ত হইয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হওয়া, ইহাই ব্রাহ্মীস্থিতি (২।৭২)। এস্থলে
দ্রষ্টব্য এই যে, দ্বিতীয় অধ্যায়ের স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা (২।৫৫-৭২), দ্বাদশ
অধ্যায়ের ভক্তের লক্ষণ (১২।১৩-২০) এবং ৩।৪র্থ প্রভৃতি অধ্যায়ে বর্ণিত কর্ম্মযোগীর
লক্ষণ (৩।২৫।২৮।৩০, ৪।১৮-২৩, ৫।৭, ১৮।২৬), এসকলই মূলতঃ এক, বর্ণনাও অনেক স্থলেই
শব্দশঃ একরূপ। একরূপ। স্থূল কথা এই, জ্ঞান, কর্ম্ম, যোগ, ভক্তি – যিনি যে পথই অবলম্বন করুন না কেন,
শেষে সিদ্ধাবস্থার লক্ষণ একরূপই দাঁড়ায়। গীতার বিশেষত্ব এই যে, গীতা জ্ঞানোত্তর
কর্ম্মের নিষেধ করেন নাই, বরং লোকসংগ্রহার্থ কর্মের উপদেশ দিয়াছেন, এবং
জ্ঞান-কর্মের সঙ্গেই ভক্তি সংযুক্ত করিয়া দিয়াছেন। গীতামতে ভক্তিদ্বারাই
ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ হয় – (পরের শ্লোক)।
মাঞ্চ যোহব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন
সেবতে।
স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায়
কল্পতে।।২৬
অর্থঃ-(২৬) যিনি ঐকান্তিক অভিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি এই তিন গুণ
অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন।
ব্রহ্মণো হি
প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য চ।
শাশ্বতস্য চ ধর্ম্মস্য
সুখস্যৈকান্তিকস্যচ।।২৭
প্রতিষ্ঠা – প্রতিমা;
ঘনীভূত ব্রহ্মৈবাহংযিথা ঘনীভূতঃ প্রকাশ এর সূর্য্যমণ্ডলং তত্ত্বদ্ ইত্যর্থঃ
(শ্রীধর)। - আমি বাসুদেব ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ ঘনীভূত ব্রহ্ম, যেমন,
সূর্য্যমণদল ঘনীভূত প্রকাশস্বরূপ, তদ্রূপ।
অর্থঃ-(২৭) যেহেতু আমি ব্রহ্মের, নিত্য অমৃতের অর্থাৎ মোক্ষের, সনাতন
ধর্ম্মের এবং ঐকান্তি সুখের প্রতিষ্ঠা, (অথবা আমি অমৃত ও অব্যয় ব্রহ্মের, শাশ্বত
ধর্ম্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা।
আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা – ভগবত্তত্ত্ব ও ব্রহ্মতত্ত্বঃ
সাংখ্যমতে ত্রিগুণাতীত হইয়া 'কেবল হওয়া' বা কৈবল্যলাভের একমাত্র উপায় পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের জ্ঞান।
পাতঞ্জলমতে ধ্যান-ধারণা ও পরিশেষে নির্ব্বীজ সমাধি; সাংখ্যে যাহাকে প্রকৃতি বলে,
অদ্বৈত বেদান্তে তাহাই অজ্ঞান বা মায়া; বেদান্ত মতে, তত্ত্বমস্যাদি মহাবাক্যের
শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন দ্বারা এই অজ্ঞান বা মায়া কাটিয়া অপরোক্ষ আত্মনুভূতি বা
ব্রহ্মভাব লাভ হয়। এস্থলে কিন্তু শ্রীভগবান্ বলিতেছেন, 'আমাকে একান্ত ভক্তিযোগে
সেবা করিলেই ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ করা যায়; কারণ, আমিই ব্রহ্মের
প্রতিষ্ঠা'; ৭।২৯ শ্লোকেও এইরূপ কথাই আছে। আবার অন্যত্র আছে, 'ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত
হইলে আমাতে পরা ভক্তি জন্মে' (১৮।৫৪)। এই 'আমি'কে, ব্রহ্ম কোন্ বস্তু, আর
ব্রহ্মভাবই বা কি? 'আমি' বলিতে অবশ্য এস্থলে বুঝায় স্বয়ং ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ।
কিন্তু ভগবানে ও ব্রহ্মে কি কোন পার্থক্য আছে? আছেও; নাইও। স্বরূপতঃ না থাকিলেও
সাধকের নিকট যে পার্থক্য আছে তাহা বুঝা যায় দ্বাদশ অধ্যায়ে অর্জ্জুনের প্রশ্নে।
তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন - 'তোমাকে যাঁহারা ত্বদ্গতচিত্ত হইয়া ভজনা করেন, আর যাঁহারা
অক্ষর ব্রহ্ম চিন্তা করেন, এ উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে?' তদুত্তরে শ্রীভগবান্
বলিলেন - 'আমার ভক্তই শ্রেষ্ঠ সাধক, তবে অক্ষর ব্রহ্মচিন্তকেরাও আমাকেই পান'। এ
কথার মর্ম্ম এই যে, অক্ষর ব্রহ্ম আমিই, ব্রহ্মভাব আমারই বিভাব, নির্গুণভাবে আমি
অক্ষর ব্রহ্ম, সগুণভাবে আমি বিশ্বরূপ, লীলাভাবে আমি অবতার – আমি পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব - 'মত্তঃ পরতং নান্যং কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় (৭।৭)',
- ব্রহ্ম, আত্মা, বিরাট্, বৈশ্বানর, তৈজস, প্রাজ্ঞ, তুরীয়, সকলই আমি, সকল অবস্থাই
আমার বিভাব বা বিভিন্ন ভাব। এই সগুণ-নির্গুণ, সৃষ্টিস্থিতি-প্রলয়কর্ত্তা,
যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্ব্বলোকমহেশ্বর পরমাত্মা পুরুষোত্তমই ভগবৎ-তত্ত্ব; আর উহার
যে অনির্দ্দেশ্য, অক্ষর নির্ব্বিশেষ, নির্গুণ বিভাব, তাহাই ব্রহ্মতত্ত্ব। এই অর্থে
বলা হইয়াছে আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা, শাশ্বত ধর্মের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।
কিন্তু
মায়াবাদী বেদান্তী বলেন – নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মই পরতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব, মায়ার বিজ্ম্ভণ,
উপাধি-কল্পিত অবস্তু – ঈশ্বরত্বন্তু জীবত্বং উপাধিদ্বয় কল্পিতং (পঞ্চদশী);
পক্ষান্তরে ভাগবত-শাস্ত্রী বলেন, স্বয়ং ভগবানই পরতত্ত্ব, ব্রহ্ম তাহার অঙ্গজ্যোতিঃ
- যদদ্বৈতং ব্রহ্মোপনিষদি তদপাস্য তনুভা (চরিতামৃত)।
বৈষ্ণব
গোস্বামীপাদের এই উক্তিকে লক্ষ্য করিয়া বেদান্তী বলেন – ওকথায় বেদ অমান্য করা হয়, কোন ঋষিপ্রণীত শাস্ত্রে এমন কথা নাই। কিন্তু
কথাটার রূপকের ভাষা ত্যাগ করিলে উহা 'আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা' গীতোক্ত এই
ভগবাদ্বোক্যের অনুবাদ বলিয়াই বোধ হয়; গীতা অবশ্য ঋষি-প্রণীত শাস্ত্র। বস্তুতঃ গীতা
ভাগবত-ধর্ম্মের গ্রন্থ, ব্রহ্মতত্ত্ব ও ভগবত্তত্ত্ব ইহাতে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
বাসুদেব-ভক্তিই ইহার প্রধান কথা; ভগবান্ বাসুদেবই পরব্রহ্ম – সগুণও তিনি নির্গুণও তিনি, তিনিই সমস্ত –
তাঁহা ভিন্ন আর কিছু নাই - 'সর্বং ত্বমেব সগুণ্যে বিগুণশ্চ ভূমন্ নানৃৎ
ত্বদন্ত্যপি মনোবচসা নিরুত্তম্' (ভাগবত ৭।৯।৪৮)। প্রশ্ন হইতে পারে, - তিনিই যখন
পরব্রহ্ম, তখন 'আমি ব্রহ্ম বলিলেই হয়, 'আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা', - একথারই বা কি
প্রয়োজন? এস্থলে প্রয়োজন আছে। ত্রিগুণাতীত কথাটা সাংখ্যদর্শনের, উহা নিরীশ্বর।
সাংখ্যমতে একমাত্র জ্ঞানই কৈবল্য-লাভের উপায় ('জ্ঞানান্মুক্তিঃ'-সাংখ্যসূত্র
৩।২০)। বেদান্ত মতেও জ্ঞানই ব্রহ্মভাব বা মোক্ষলাভের উপায়, ব্রহ্মসূত্রে কোথায়ও
ভক্তি শব্দ নাই। কিন্তু এস্থলে ভগবান্ বলিতেছেন –
ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভের উপায় আমাতে (অর্থাৎ ভগবান্ বাসুদেবে)
অব্যভিচারিণী ভক্তি। কাজেই তাঁহাকে বুঝাইতে হইল যে ব্রহ্মভাব আমারই অর্থাৎ ভগবান্
পুরুষোত্তমেরই বিভাব অর্থাৎ ভগবৎ-তত্ত্বেই প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং ভগবান্
ভক্তিদ্বারাই অধিগম্য। সাধনপথে ভক্তির উপযোগিতা স্বীকার করিলেই ভগবত্তত্ত্বের
শ্রেষ্ঠতা স্বতঃই আসিবে, এই হেতু গীতা-বেদান্তাদি শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব স্বীকার
করিলেও উহাতে ঈশ্বর-বাদেরই প্রাধান্য।
গীতা
সাধারণভাবে সেই সেই দর্শনের (সাংখ্য, বেদান্তাদির) মূল প্রতিপাদ্য অস্বীকার করিয়া
তাহার সহিত ঈশ্বরবাদ সংযুক্ত করিয়া তাহাদিগকে সুসম্পূর্ণ করিয়াছেন। এই ঈশ্বরবাদই
গীতার প্রাণ; গীতার আদি, অন্ত, মধ্য– সমস্তই ঈশ্বরবাদে সমুজ্জল। - বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ,
গীতার ঈশ্বরবাদ।
কিন্তু যাঁহারা ঈশ্বরতত্ত্বকে গৌণ
করিয়া ব্রহ্মতত্ত্বই পরতত্ত্ব বলিয়া গ্রহণ করেন, তাঁহাদের পক্ষে 'আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা' এই কথার সরল অর্থ গ্রহণ করা
চলে না। কাজেই তাঁহারা এই বাক্যের শব্দার্থ লইয়া অনেক 'টানাবুনা' করিয়াছেন। কেহ
বলেন, এ স্থলে 'আমি' বলিতে বুঝায় 'নিরুপাধিক ব্রহ্ম' এবং 'ব্রহ্ম' বলিতে বুঝায়
'সোপাধিক ব্রহ্ম' কেহ বলেন, এস্থলে ব্রহ্ম অর্থ প্রকৃতি, 'আমি' পরব্রহ্ম; কেহ বলেন,
এস্থলে 'ব্রহ্ম' অর্থ বেদ ইত্যাদি; এরকম পূর্ব্বাপর সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রক্ষা হয়
না। উহা 'গরজমূলক, সরল নহে'।
আবার এই
মতাবলমসী কেহ কেহ পূর্ব্বোক্ত সরল অর্থই গ্রহণ করেন, কিন্তু বলেন যে সম্ভবতঃ এই
শ্লোকটি প্রক্ষিপ্ত। 'প্রক্ষেপের' কারণস্বরূপ বলেন –
"পূর্ব্ব
শ্লোকে বলা হইতেছে যে কৃষ্ণকে ভক্তি করিলে ব্রহ্মভাব লাভ করা যায়। ইহাতে ব্রহ্মেরই
শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হয়। ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তিই লক্ষ্য। ইহার উপায় কৃষ্ণভক্তি। যাহা
লক্ষ্য তাহাই শ্রেষ্ঠতর; লক্ষ্য অপেক্ষা পথ শ্রেষ্ঠ হয় না। কিন্তু কৃষ্ণভক্তি
অপেক্ষা পরব্রহ্ম প্রাপ্তি শ্রেষ্ঠ হইবে, বৈষ্ণব পণ্ডিতগণ এভাব পছন্দ করেন নাই।
ব্রহ্মকে হীন করিয়া কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ করা আবশ্যক হইয়াছিল। এই জন্য কোন বৈষ্ণব
পণ্ডিত 'ব্রহ্মণ্যেহিপ্রতিষ্ঠাহং," ইত্যাদি অংশ
সংযোজন করিয়াছেন – স্বর্গত মহেশচন্দ্র ঘোষ, প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩৩৫।
এ সন্বন্ধে
বিবেচ্য এই যে – শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য এই শ্লোক গ্রহণ করিয়াছেন, সুতরাং
প্রক্ষেপ হইলে তাঁর পূর্ব্ববর্ত্তী কালে হইয়াছে। সেই প্রাচীনকালে কোন বৈষ্ণব
পণ্ডিত উক্তরূপ উদ্দেশ্য লইয়া বৈষ্ণবগণের নমস্য শ্রীগীতার মধ্যে কোন অংশ
প্রক্ষিপ্ত করা আবশ্যক বোধ করিয়াছেন, এরূপ সিদ্ধান্ত বিশেষ প্রমাণ-সাপেক্ষ। সে
যাহা হইক, পূর্ব্বোক্তরূপ যুক্তি অবলম্বন করিলে শ্রীগীতার অন্যান্য স্থলের আলোচনায়
ইহার ঠিক বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হয়, এস্থলে যেমন বলা হইয়াছে, আমাতে ভক্তি
করিলে ব্রহ্মভাব লাভ হয় (১৪।২৬), আবার ৮।৫৪-৫৫ শ্লোকে বলা হইয়াছে যে, 'ব্রহ্মভাব
লাভ হইলে আমাতে পরা-ভক্তি জন্মে এবং ভক্তিদ্বারাই আমাকে তত্ত্বতঃ জানিয়া আমাতে
প্রবেশ করা যায়'। পূর্ব্বোক্ত যুক্তি-বলেই বলা যায় যে, এস্থলে ব্রহ্মভাব হইতে
কৃষ্ণভক্তিকেই শ্রেষ্ঠ বলা হইয়াছে এবং ব্রহ্মতত্ত্বের উপরে ভগবত্তত্ত্বকে স্থাপন
করা হইয়াছে। বস্তুতঃ কৃষ্ণ বড় কি ব্রহ্ম বড়, এরূপ ধারণা সাম্প্রদায়িক সংস্কারবশতঃ
উপস্থিত হয়। উভয়েই তত্ত্বতঃ একই বস্তু, ব্রহ্মতত্ত্ব ও ভগবত্তত্ত্ব একই বস্তুর
বিভিন্ন বিভাব। পূর্ব্বোক্ত উভয় স্থলের সংযোগে এইরূপ অর্থই স্পষ্ট প্রতীত হয় যে,
পরম জ্ঞান ও পরা ভক্তি একই অবস্থা এবং যে পরম পুরুষকে ভক্তি করা যায় এবং যাঁহাতে
প্রবেশ করা যায়, ব্রহ্মভাব তাহারই একটি বিভাব, সুতরাং তাঁহার অন্তর্ভূক্তি।
চতুর্দ্দশ অধ্যায় – বিশ্লেষণ ও সার-সংক্ষেপ
গুণত্রয়-বিভাগযোগ
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে পুরুষ-প্রকৃতি
বিচারে বলা হইয়াছে যে পুরুষ অকর্ত্তা, নিঃসঙ্গ; প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই পুরুষের
সদসৎ যোনিতে জন্ম বা সংসারিত্ব। এই ত্রিগুণের লক্ষণ কি, কি ভাবে উহারা জীবকে আবদ্ধ
করে, কিরূপে ত্রিগুণাতীত হইয়া মুক্ত হওয়া যায়, ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ কি – এই সকল বিষয় বিস্তারিত বলা হয় নাই।
আবার, দ্বিতীয় অধ্যায়ে কর্ম্মযোগের উপদেশ-প্রসঙ্গে শ্রীভগবান্ অর্জ্জুনকে
বলিয়াছেন, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও, নিত্যসত্ত্বস্থ হও। এ সকল কথার প্রকৃত তাৎপর্য
পূর্ব্বে বলা হয় নাই। এই হেতুই এই অধ্যায়ের এই ত্রিগুণতত্ত্ব পুনরায় বিস্তারিতভাবে
বলিতেছেন।
সৃষ্টি-রহস্যঃ – এই চরাচর জগৎ প্রকৃতিরই পরিণাম,
কিন্তু প্রকৃতির স্বয়ং সৃষ্টির সামর্থ্য নাই, পরমেশ্বরের সৃষ্টি-সঙ্কল্পই
প্রকৃতিতে গর্ভাধানস্বরূপ; উহা হইতে ভূতসৃষ্টি। পরমেশ্বর ভূতগণের পিতৃস্বরূপ এবং
প্রকৃতি মাতৃ-স্বরূপিণী। (কিন্তু নিরীশ্বর সাংখ্যমতে প্রকৃতি প্রসবধর্মী অর্থাৎ স্বয়ংই
সৃষ্টিসমর্থা; গীতার উহা মান্য নহে।)
পুরুষের সংসার বন্ধন – সত্ত্ব, রজঃ,
তমঃ, - প্রকৃতির এই তিন গুণ। এই গুণসঙ্গবশতঃ পুরুষের সংসারবন্ধন। মিশ্র সত্ত্বগুণের
মুখ্য ধর্ম্ম সুখ ও জ্ঞান। উহার ফলে জীব বিষয়-সুখ ও বৈষয়িক জ্ঞানে আবদ্ধ হইয়া 'আমি
জ্ঞানী' ইত্যাদি রূপ অভিমান করতঃ বিষয়ে আবদ্ধ হয়। রজোগুণের ধর্ম্ম রাগাত্মক, উহার ফল
তৃষ্ণা ও আসক্তি – উহাতে জীব বিবিধ কর্ম্মে আসক্ত হইয়া দুঃখভোগ করে।
তমোগুণের ধর্ম্ম মোহ, অজ্ঞান – উহা প্রমাদ,
আলস্য, নিদ্রাদি দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে। এই তিন গুণ পৃথক্ পৃথক্ থাকে না, অপর দুইটিকে
অভিভূত করিয়া কোন একটি প্রবল হয় (গুণত্রয়ের বৈষম্যই সৃষ্টি। গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থাই
অব্যক্তাবস্থা বা প্রলয়)।
সাত্ত্বিকাদি ত্রিবিধ স্বভাবের লক্ষণ – সত্ত্বগুণ প্রবল হইলে সর্ব্ব ইন্দ্রিয়-দ্বারে প্রকাশ বা নির্ম্মল জ্ঞান উৎপন্ন
হয়। রজোগুণ প্রবল হইলে প্রবল বিষয়স্পৃহা, কর্ম্ম-প্রবৃত্তি, অস্থিরতা ইত্যাদি উৎপন্ন
হয়। তমোগুণ প্রবল হইলে অনুদ্যম, কর্ত্তব্যের বিস্মৃত, বুদ্ধি-বিপর্য্যয় প্রভৃতি লক্ষণ
উপস্থিত হয়। সাত্ত্বিক কর্ম্মের ফল সুখ, রাজসিক কর্ম্মের ফল দুঃখ, তামসিক কর্ম্মের
ফল অজ্ঞান।
সত্ত্বগুণবৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে স্বর্গাদি দিব্যলোক প্রাপ্তি
হয়, রজোগুণ বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে মনুষ্যযোনিতে জন্ম হয় এবং তমোগুণ বৃদ্ধিকালে মৃত্যু
হইলে পশ্বাদি মূঢ়-যোনিতে জন্ম হয়। সাত্ত্বিক গুণের প্রাবল্যে স্বর্গাদিলাভ হয় বটে,
কিন্তু ত্রিগুণাতীত না হইলে মোক্ষলাভ হয় না।
ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ – ত্রিগুণাতীত
হইবার উপায় –
দেহে গুণের কার্য্য চলিতে থাকিলেও যিনি উদাসীনের ন্যায় সাক্ষিস্বরূপে
অবস্থিতি করেন, সত্ত্বাদি-গুণধর্ম্ম সুখদুঃখাদি কর্ত্তৃক বিচালিত হন না, তিনিই ত্রিগুণাতীত;
যাঁহার সর্ব্ববিষয়ে সমত্ববুদ্ধি, যাঁহার নিকট সুখদুঃখ, মান-অপমান, স্তুতি-নিন্দা, শত্রু-মিত্র
সকলই সমান, তিনি ত্রিগুণাতীত।
যিনি একনিষ্ঠ ভক্তিযোগ সহকারে ভগবান্ পুরুষোত্তমের ভজনা
করেন, তিনিই ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন। কারণ নির্গুণ ব্রহ্মভাব,
শাশ্বত ধর্ম, ঐকান্তিক সুখ, এ সকলেরই একমাত্র আশ্রয় বা প্রতিষ্ঠা তিনিই।
এই অধ্যায়ে প্রধানতঃ ত্রিগুণতত্ত্বই বর্ণিত হইয়াছে, এই হেতু
ইহাকে গুণত্রয়বিভাগযোগ বলে।
ইদি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
গুণত্রয়বিভাগযোগো নাম চতুর্দ্দশোহধ্যায়ঃ।
No comments:
Post a Comment