Popular Posts

Friday, August 19, 2011

গীতা-প্রবেশিকা [ভূমিকা-২] : বৈদিক ধর্ম্মের ক্রমবিকাশ - সনাতন ধর্ম্মের বিভিন্ন অঙ্গ : (১) ঋগ্ বেদীয় ধর্ম্ম :



ঋগ্বেদই সনাতন ধর্ম্মের প্রথম গ্রন্থ। উহা প্রাচীনতম আর্য্যধর্ম্মের ও আর্য্যসভ্যতার অকৃত্রিম প্রতিচ্ছবি। উহার ঋক্ বা মন্ত্রগুলি প্রায় সমস্তই ইন্দ্র, অগ্নি, সূর্য্য, বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবগণের স্তব-স্তুতিতে পূর্ণ। এই সকল মন্ত্রদ্বারা প্রাচীন আর্য্যগণ দেবগণের উদ্দেশ্যে যাগযজ্ঞ করিয়া অভীষ্ট প্রার্থনা করিতেন। কিন্তু দেবতা অনেক থাকিলেও তাঁহারা এক ঐশী শক্তিরই বিভিন্ন বিকাশ এবং ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় - এ তত্ত্ব তখনো অবিদিত ছিল না। অনেক মন্ত্রে একথা স্পষ্টরূপেই উল্লিখিত হইয়াছে, - (১) তিনি এক ও সত্য (নিত্য), তাঁহাকেই বিপ্রগণ বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকেন - তাঁহাকেই অগ্নি, যম, মাতরিশ্বা বলা হয়। (একংসদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি' ইত্যাদি ঋক্ ১।১৬৪।৪৬)। (২) 'যিনি আমাদিগের পিতা ও জন্মদাতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভূবনের সকল স্থান অবগত আছেন, যিনি অনেক দেবগণের নাম ধারণ করেন কিন্তু এক ও অদ্বিতীয়, ভূবনের লোকে তাহাকে জানিতে ইচ্ছা করে' ('যো দেবানাং নামধা এক এব' ইত্যাদি ঋক্ ১০।৮২।৩)।' (৩) (ক) তখন (মূলারম্ভে) অসৎও ছিল না, সৎও ছিল না, অন্তরীক্ষ ছিল না এবং তাহার অতীত আকাশও ছিল না; কে (কাহাকে) আবরণ করিল? কোথায়? কাহার সুখের জন্য? অগাধ ও গহন জল কি তখন ছিল? (খ) তখন মৃত্যুও ছিল না, অমৃতত্ত্বও ছিল না; রাত্রি ও দিনের ভেদ ছিল না। সেই এক ও অদ্বিতীয় এক মাত্র আপন শক্তিদ্বারাই বায়ু ব্যতীত, শ্বাসোচ্ছ্বাস করিয়া স্ফূর্ত্তিমান্ ছিলেন, তাঁহা ব্যতীতি অন্য কিছু ছিল না। (নাসদাসীন্নো সদাসীৎ তদানীং' ইত্যাদি ঋক্ ১০।১২৯)।

এই শেষোদ্ধৃত অংশটা ঋগবেদীয় প্রসিদ্ধ নাসদীয় সূক্তের প্রথম দুই ঋক্। এই সূক্তের দেবতা - পরমাত্মা। সৃষ্টির পূর্ব্বে কি ছিল, এই সূক্তে ঋষি তাহারই উত্তর দিতেছেন। এই নামরূপাত্মক ব্যক্ত দৃশ্য প্রপঞ্চের অতীত এক অব্যক্ত অদ্বয় তত্ত্ব আছে যাহা হইতে এই জগৎ-প্রপঞ্চ উৎপন্ন হইয়াছে বাঁ যাহাই এই জগৎ-প্রপঞ্চরূপে অভিব্যক্ত হইয়াছে, ইহাই ঋষির বলার অভিপ্রায়। কিন্তু সে তত্ত্ব অজ্ঞেয়, অনির্ব্বাচ্য; সৎ, অসৎ, অমৃত, মর্ত্ত্য, আলো (দিবা), অন্ধকার (রাত্রি) ইত্যাদির পরস্পর দ্বৈত বাঁ কথার জুরী সৃষ্টির পরে উৎপন্ন হইয়াছে। উহার একটা বলিলেই অপরটার জ্ঞান সঙ্গে সঙ্গেই আসে। কিন্তু যখন এক ভিন্ন দুই ছিল না সেই এক অদ্বিতীয় তত্ত্ব সন্বন্ধে এই দ্বৈত ভাষার ব্যবহার করা চলে না; তাই বলা হইতেছে, সৎও নয় অসৎও নয় ইত্যাদি। সেইরূপ, জলে বাঁ আকাশে সমস্ত আবৃত ছিল ইত্যাদি যে বলা হয় তাহাও বসু আবার আকাশাদির ন্যায় জড় পদার্থ নয়, চৈতন্যময় - তাই বলা হইতেছে - 'শ্বাসোচ্ছ্বাস করিতেছেন,' কিন্তু শ্বাসোচ্ছ্বাসে বায়ুর প্রয়োজন, বায়ু ত তখন হয় নাই, তাই বলা হইতেছে, "বিনা বায়ুতে, আত্মশক্তি দ্বারা"। ঋষির অন্তর্দ্দৃষ্টি কতদূর, লক্ষ্য করুন। জগতের আদি, অব্যক্ত মূলতত্ত্বের এমন কৌশলময় গভীর মূলস্পর্শী বিচার ও বর্ণনা কোন দেশের কোন ধর্ম্মগ্রন্থে কখনও হয় নাই। আর এ বিচার, এই জ্ঞানের উদয় হইয়াছিল ভারতে কখন? - সেই সুদূর প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগে আর্য্য সভ্যতার প্রাচীনতম অবস্থায়, যখন প্রায় সমস্ত আধুনিক সভ্যজগৎ অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। আধুনিক পাশ্চাত্য অজ্ঞেয়বাদিগণ পর্য্যন্ত এই বৈদিক সুত্রের প্রাচীনত্ব ও ভাবগাম্ভীর্য্য চিন্তা করিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিতেছেন। পরবর্ত্তীকালে এই তত্ত্বই উপনিষৎ সমূহে নানাভাবে বিবৃত হইয়াছে। বস্তুতঃ ঋগবেদীয় ধর্ম্ম কেবল অগ্নিতে ঘৃতাহুতি এবং নানা দেবতার নিকট গো-বৎসাদির জন্য পার্থনা - ইহাই নহে।

আমরা দেখিতেছি - (১) ঋগ্বেদীয় ঋষি জগৎ-প্রপঞ্চের অতীত অদ্বয় অব্যক্ত তত্ত্বের সন্ধান পাইয়াছিলেন। (২) সেই তত্ত্বই আবার জগতের এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরও সৃষ্টিকর্ত্তা এবং দেবতাগণ সেই ঐশী শক্তিরই বিভিন্ন বিকাশ, ইহা জানিতেন। (৩) যজ্ঞদ্বারা দেবতা পরিতুষ্ট হইলে অভীষ্ট ফল প্রদান করেন, ইহা বিশ্বাস করিতেন এবং তদর্থে স্তব-স্তুতি সহ যজ্ঞ করিতেন। (৪) সেই সজ্ঞাদি শ্রদ্ধার সহিত সম্পন্ন হইত এবং "অর্চ্চনা" "বন্দনা" "নমস্কার" ইত্যাদি ভক্ত্যঙ্গযুক্ত ছিল। (শ্রদ্ধাং দেবা যজমানা বায়ু গোপা উপাসতে" - ঋক্ ১০।১৫১; "নমো ভরন্ত এমসি" ঋক্ ১।৭; 'দেবা বশিষ্টো অমৃতান্ ববন্দে' ঋক ১০।৬৬; "বিষ্ণবে চার্চ্চত", ইত্যাদি ঋক্)। সুতরাং সনাতন ধর্ম্মের এই প্রাচীন স্বরূপ যজ্ঞপ্রধান হইলেও জ্ঞানভক্তি-বিবর্জ্জিত ছিল না - কর্ম্ম, জ্ঞান ও উপাসনা তিনেরই উহাতে সমাবেশ ছিল।

No comments:

Post a Comment