Popular Posts

Sunday, July 19, 2015

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : পঞ্চদশোহধ্যায় (শ্লোক অর্থসহ)


শ্রীভগবানুবাচ -

ঊর্দ্ধমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্।
ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ।।১

ঊর্দ্ধমূলং- ঊর্দ্ধমুত্তমঃ ক্ষরাক্ষরাভ্যামুৎকৃষ্টঃ পুরুষোত্তমঃ মূলং যস্য তম্‌ (শ্রীধর) ঊর্দ্ধ অর্থাৎ ক্ষর ও অক্ষর হইতেও শ্রেষ্ঠ পুরুষোত্তম যাহার মূল। পুরুষোত্তম বা পরমাত্মা হইতেই সংসারের সৃষ্টি, উহার মূলকারণ তিনিই।

অর্থঃ এস্থলে সংসারকে অশ্বত্থবৃক্ষের সহিত তুলনা করা হইয়াছে। এই সংসার বৃক্ষ ঊর্দ্ধমূল, কেননা পুরুষত্তম বা পরমাত্মা হইতেই এই বৃক্ষ উৎপন্ন হইয়াছে। এই হেতু ইহাকে ব্রহ্মবৃক্ষও বলা হয়। এই বৃক্ষের শাখাস্থানিয় মহত্তত্ত্ব, অহংকার প্রভৃতি পরিণামগুলি ক্রমশঃ অধোগামী, এই হেতু ইহা অধঃশাখ। পুরুষত্তম বা পরব্রহ্ম হইতে কিরূপে প্রকৃতির বিস্তার হইয়াছে তাহা এইরূপঃ-

পরব্রহ্ম বা পুরুষোত্তম


১ পুরুষ
+
১ প্রকৃতি
(গীতার পরা প্রকৃতি)


(গীতার অপরা প্রকৃতি)

১ মহত্তত্ত্ব বা বুদ্ধিতত্ত্ব






১ অহংকার










(সত্ত্বগুণের প্রাবল্যে)

(তমোগুণের প্রাবল্যে)











৫ জ্ঞানেন্দ্রিয়
৫ কর্ম্মেন্দ্রিয়

৫ পঞ্চতন্মাত্র






৫ পঞ্চ স্থূলভূত
এই সংসারবৃক্ষ অব্যয়, কারণ ইহা অনাদিকাল হইতে প্রবৃত্ত। বেদত্রয় এই সংসারবৃক্ষের পত্র, কারণ পত্রসমূহ যেমন বৃক্ষের আচ্ছাদনহেতু রক্ষার কারণ, সেইরূপ বেদত্রয়ও ধর্ম্মাধর্ম্ম প্রতিপাদন দ্বারা ছায়ার ন্যায় সর্ব্বজীবের রক্ষক ও আশ্রয়স্বরূপ। এই সংসার বৃক্ষকে যিনি জানেন তিনি বেদজ্ঞ, কারণ সমূল সংসারবৃক্ষকে জানিলে জীব, জগৎ ব্রহ্ম এই তিনেরই জ্ঞান হয়, আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না।

চতুর্দ্দশ অধ্যায়ের শেষে শ্রীভগবান্‌ বলেছেন, যে অনন্যা ভক্তিযোগে আমার সেবা করে, সে ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়; আমি ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা। ত্রিগুণাতীত হওয়ার অর্থ, এই সংসারপ্রপঞ্চ অতিক্রম করা। ইহাকে সংসার-ক্ষয় বলে। সুতরাং এই কথাটা বুঝাইবার জন্যই সংসার কি, উহার মূল কারণ কোথায়, এই অধ্যায়ে প্রথমতঃ তাহাই বর্ণনা করে হয়েছে এবং শেষে সর্ব্বকারণের কারণ যে তিনিই এই কথা বলিয়া পুরুষোত্তমরূপে শ্রীভগবান্‌ আত্ম-পরিচয় দিয়েছেন। এই পুরুষোত্তমতত্ত্বই ভাগবত ধর্ম্মের ও গীতার কেন্দ্র-স্বরূপ

অধশ্চোর্দ্ধং প্রসৃতাস্তস্যশাখা গুণপ্রবৃদ্ধা বিষয়প্রবালাঃ।
অধশ্চ মূলান্যনুসন্ততানি কর্মানুবন্ধীনি মনুষ্যলোকে।।২

অর্থঃ- (২) সত্ত্বাদি গুণের দ্বারা বিশেষরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, বিষয়রূপ তরুণপল্লব-বিশিষ্ট উহার শাখাসকল অধোভাগে ও ঊর্দ্ধভাগে বিস্তৃত। উহার (বাসনারূপ) মূলসমূহ ধর্ম্মাধর্ম্মরূপ কর্মের কারণ বা প্রসূতি।

তাৎপর্য্য পূর্ব্ব শ্লোকে সংসারবৃক্ষের বৈদিক বর্ণনার উল্লেখ করা হইয়াছে। এই শ্লোকে সাংখ্য-দৃষ্টিতে উহারই বিস্তারিত বর্ণনা করা হইয়াছে। এই সংসার প্রকৃতিরই বিস্তার। সুতরাং ঐ বৃক্ষের শাখা-সকল গুণ-প্রবৃদ্ধ, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনগুণের দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত। শব্দ-স্পর্শাদি বিষয়সমূহ উহার প্রবাল বা তরুণপল্লব স্থানীয়। এই হেতু উহা বিষয়-প্রবাল। উহার শাখাসমূহ ঊর্দ্ধ ও অধোদিকে বিস্তৃত অর্থাৎ কর্ম্মানুসারে জীবসকল অধোদিকে পশ্বাদি যোনিতে এবং ঊর্দ্ধদিকে দেবাদি যোনিতে প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে। উহার বাসনারূপ মূলসকল কর্মানুসন্ধি অর্থাৎ ধর্মাধর্ম্মরূপ কর্মের প্রসূতি। এই মূলসকল অধোদিকে মনুষ্য-লোকে বিস্তৃত রহিয়াছে, কারণ মনুষ্যগণেরই কর্মাধিকার ও কর্ম্মফল বিশেষরূপে প্রসিদ্ধ। পূর্ব্ব শ্লোকে বলা হইয়াছে, পরমেশ্বরই উহার প্রধান মূল। এই শ্লোকোক্ত মূলগুলি অবান্তর মূল (ঝুড়ি)। বাসনাদ্বারাই লোক ধর্মাধর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়, সুতরাং বাসনাজালই অবান্তর মূল।

ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে নান্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা।
অশ্বত্থমেনং সুবিরূঢ়মূলমসঙ্গশস্ত্রেণ দৃঢ়েন ছিত্ত্বা।।৩
ততঃ পদং তৎ পরিমার্গিতব্যং যস্মিন্ গতা ন নিবর্ত্তন্তি ভূয়ঃ।
তমেব চাদ্যং পুরুষং প্রপদ্যে যতঃ প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পূরাণী।।৪

অর্থঃ- (৩।৪) এই সংসারে স্থিত জীবগণ সংসার বৃক্ষের পূর্ব্বোক্ত ঊর্দ্ধমূলাদিরূপ উপলব্ধি করিতে পারে না; সেইরূপ উহার আদি, অন্ত এবং স্থিতিও উপলব্ধি করিতে পারে না; এই সুদৃঢ়মূল অশ্বত্থবৃক্ষকে তীব্র বৈরাগ্যরূপ শস্ত্রদ্বারা ছেদন করিয়া, তৎপর যাঁহাকে প্রাপ্ত হইলে আর পুনর্জ্জন্ম হয় না, যাঁহা হইতে এই সংসার-প্রবৃত্তির বিস্তার হইয়াছে আমি সেই আদি পুরুষের শরণ লইতেছি এই বলিয়া তাঁহার অণ্বেষণ করিতে হইবে।

তাৎপর্য্য মায়াবদ্ধ জীব এই সংসারের প্রকৃত স্বরূপ যে কি তাহা বুঝিতে পারে না; ইহার আদি কোথায়, ইহার অন্ত কোথায়, উহার স্থিতি কোথায় অর্থাৎ কি আধার অবলম্বন করিয়া উহা অবস্থিত আছে, তাহাও সে কিছুই জানে না। বাসনা ত্যাগ না হইলে মায়া দূর হয় না, তত্ত্বজ্ঞান হয় না। সুতরাং বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রদ্বারা মায়াবন্ধন ছেদন করা কর্ত্তব্য। তৎপর যাহা হইতে এই সংসার-প্রবৃত্তি বিস্তৃত হইয়াছে, সেই ভক্তবৎসল পরমেশ্বরকেই আশ্রয় করিয়া ঐকান্তিক ভক্তিসহকারে তাঁহার অণ্বেষণ করিতে হইবে। কারণ তাঁহার কৃপা ব্যতীত ত্রিগুণ অতিক্রম করা যায় না, সংসারবন্ধন ঘুচে না।

নির্ম্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ।
দ্বন্দ্বৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈর্গচ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ।।৫

অর্থঃ- (৫) যাঁহাদের অভিমান ও মোহ নাই, যাঁহারা সংসার-আসক্তি জয় করিয়াছেন, যাহারা আত্মতত্ত্বে নিষ্ঠাবান্‌, যাঁহাদের কামনা নিবৃত্ত হইয়াছে, যাহারা সুখদুঃখ-সংজ্ঞক দ্বন্দ্ব হইতে মুক্ত, তাদৃশ বিবেকী পুরুষগণ সেই অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন।

ন তদ্ ভাসয়তে সূর্য্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ।
যদ্গত্বা ন নিবর্ত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।৬

অর্থঃ- (৬) যে পদ প্রাপ্ত হইলে সাধক আর সংসারে প্রত্যাবর্ত্তন করেন না, যে পদ সূর্য্য, চন্দ্র বা অগ্নি প্রকাশ করিতে পারে না তাহাই আমার পরমস্বরূপ।

তিনি স্বপ্রকাশ। তাঁহার প্রকাশেই জগৎ প্রকাশিত। জড় পদার্থ চন্দ্র-সূর্য্যাদি তাঁহাকে প্রকাশ করিবে কিরূপে? এই শ্লোকটি প্রায় অক্ষরশঃই শ্বেতাশ্বতর ও কঠোপনিষদে আছে।

মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ।
মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি।।৭

অর্থঃ- (৭) আমায় সনাতন অংশ জীব হইয়া প্রকৃতিতে অবস্থিত মন ও পাঁচ ইন্দ্রিয়কে সংসারে অর্থাৎ কর্ম্মভূমিতে আকর্ষণ করিয়া থাকে।

পূর্ব্ব শ্লোকে বলা হইয়াছে যে, তাঁহাকে প্রাপ্ত হইলে জীবের প্রত্যাবর্ত্তন হয় না। মোক্ষ বা ঈশ্বর প্রাপ্তি না হওয়া পর্য্যন্ত জীবের পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু, জরাদুঃখাদি ভোগ করিতে হয়। এই কথা স্পষ্টীকৃত করার উদ্দেশ্যেই জীবের স্বরূপ কি, কিরূপে তাহার উৎক্রমণ হয়, ইত্যাদি বিষয় এই কয়েকটি শ্লোকে বলা হইতেছে।

জীব ও ব্রহ্মে ভেদ ও অভেদ জীব ও ব্রহ্ম এক, না পৃথক? এ সন্বন্ধে নানারূপ মতভেদ আছে এবং এই সকল মতভেদ লইয়াই দ্বৈতবাদ, অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রভৃত নানাবিধ মতবাদের সৃষ্টি হইয়াছে। এ সন্বন্ধে গীতার মত কি তাহাই আমাদের দ্রষ্টব্য। গীতার নানাস্থলেই জীবব্রহ্মৈক্যবাদই স্বীকৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আত্মার অবিনাশিতা বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে জীব অজ, নিত্য সনাতন, অবিনাশী, অবিকারী, সর্ব্বব্যাপী, অচিন্ত্য, অমেয় ইত্যাদি। অবিকারিত্ব, সর্ব্বব্যাপিত্ব, উৎপত্তি-বিনাশ-রাহিত্য ইত্যাদি ব্রহ্মেরই লক্ষণ। অন্যত্র শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন আমিই সর্ব্বভূতাশয়াস্থিত আত্মা। আমাকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও, আসুরী প্রকৃতির লোক শরীরস্থ আমাকে কষ্ট দেয় ইত্যাদি। এই সকল স্থলে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে, ভগবান্‌ই দেহে জীবরূপে অবস্থিত আছেন। তত্ত্বমসি, সোহহং, অহং ব্রহ্মাস্মি, অয়মাত্মা ব্রহ্ম চারি বেদের এই চারিটি মহাবাক্যও এই সত্যই প্রচার করিতেছে যে জীবই ব্রহ্ম। কিন্তু এস্থলে বলা হইল জীব আমার সনাতন অংশ। এ অংশ কিরূপ? অদ্বৈতবাদী বলেন ব্রহ্ম অখণ্ড, অপরিচ্ছিন্ন, নিরবয়ব অদ্বয় বস্তু, উহার খণ্ডিত অংশ কল্পনা করা যায় না। এস্থলে অংশ বলিতে এইরূপ বুঝিতে হইবে যেমন ঘটাকাশ, মঠাকাশ ইত্যাদি মহাকাশের অংশ। ঘটের বা মঠের মধ্যে যে আকাশ আছে তাহাকে মহাকাশের অংশ বলা যায়, ঘট বা মঠ ভাঙ্গিলে এক অপরিচ্ছিন্ন আকাশই থাকে। জীবেরও দেহোপাধিবশতঃ ব্রহ্ম হইতে পার্থক্য, দেহোপাধিনাশে এক অপরিচ্ছিন্ন ব্রহ্মসত্ত্বাই অবশিষ্ট থাকে (ব্রহ্মাদ্বয়ং শিষ্যতে)।

অপর পক্ষে কেহ কেহ বলেন জীব ও ঈশ্বর উভয়ই চিদ্রুপ চেতন, এই নিমিত্ত অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্মের চেতনাংশের সাদৃশ্যেই উভয়ের একত্ব। কিন্তু তাহা হইলেও জিব, ব্রহ্মের রশ্মি-পরমাণু স্থানীয়; যেমন তেজোময় সূর্য্য হইতে অনন্ত রশ্মি বহির্গত হয়, অথবা অগ্নিপিণ্ড হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গসমূহ নির্গত হয়, সেইরূপে ব্রহ্ম হইতে জীবসমূহের উৎপত্তি (যথা সুদীপ্তাৎ পাপকাদ্বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে সরূপাঃ ইত্যাদি মুণ্ডক। অগ্নি ভিন্ন স্ফুলিঙ্গের পৃথক্‌ অস্তিত্ব নাই, ব্রহ্ম ভিন্নও জীবের পৃথক্‌ সত্ত্বা নাই। স্ফুলিঙ্গ অগ্নিই বটে, কিন্তু ঠিক অগ্নিও নয়, অগ্নি-কণা। জীব ও ব্রহ্মেও সেইরূপ অভেদ ও ভেদ আছে, জিব ব্রহ্মকণা। ইহাই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অচিন্ত্য ভেদাভেদবাদ

শ্রীমৎ শংকারাচার্য্য কতকটা এইরূপ ভাবেই জীবব্রহ্মের ভেদাভেদের রহস্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন চৈতন্যঞ্চাবশিষ্টং জীবেশ্বরয়োর্যথাগ্নি-বিস্ফুলিঙ্গ-য়োরৌষ্ণ্যম্‌অতো ভেদাভেদাগমাভ্যামংশত্বাব-গমঃ জীব ব্রহ্মের চৈতন্যাংশে কোন বৈশিষ্ট্য না থাকিলেও, যেমন অগ্নি-স্ফুলিঙ্গের উষ্ণতাংশে ভেদ প্রতীত হয়, এইরূপ ভেদাভেদ বোধ হওয়ার অংশের অবগতি হইয়া থাকে।

বস্তুতঃ অংশ ও অংশীতে স্বরূপতঃ কোন ভেদ হইতে পারে না। যতক্ষণ আমিত্বের উপাধি ততক্ষণই ভেদ। মুক্তিই অভেদ। কিন্তু ভক্ত মুক্তি চান না, আমিটা ত্যাগ করিতে চান না, তিনি বলেন চিনি হওয়া ভাল নয় মন, চিনি খেতে ভালবাসি, - তাই তিনি অভেদও মান্য করেন না। তাই ভক্তিশাস্ত্র বলেন জীব কৃষ্ণের নিত্যদাস।

শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুৎক্রামতীশ্বরঃ।
গৃহীত্বৈতানি সংযাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ।।৮

অর্থঃ- (৮) যেমন বায়ু পুস্পাদি হইতে গন্ধবিশিষ্ট সূক্ষ্ম কণাসমূহ লইয়া যায়, তদ্রুপ জীব যখন এক দেহ পরিত্যাগ করিয়া অন্য দেহে প্রবেশ করেন, তখন এই সকলকে (এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যান।

শ্রোত্রং চক্ষুঃ স্পর্শনঞ্চ রসনং ঘ্রাণমেবচ।
অধিষ্ঠায় মনশ্চায়ং বিষয়ানুপসেবতে।।৯

অর্থঃ- (৯) জীবাত্মা কর্ণ, চক্ষু, ত্বক্‌, নাসিকা এবং মনকে আশ্রয় করিয়া শব্দাদি বিষয়সকল ভোগ করিয়া থাকেন।

জন্মান্তর-রহস্য জীবের উৎক্রান্তি সূক্ষ্মশরীরঃ

প্রশ্নঃ আত্মা অকর্ত্তা, উদাসীন, নিত্যযুক্ত। প্রকৃত বা দেহ-বন্ধন বশতঃই তিনিবদ্ধ হন। মৃত্যুর পর যখন সেই দেহবন্ধন চলিয়া যায়, তখনই ত তিনি মুক্ত হইয়া স্ব-স্বরূপ লাভ করিতে পারেন? তখন আর প্রকৃতি থাকে কোথায়? দ্বিতীয়তঃ, জীব একদেহে পাপপুণ্যাদি সঞ্চয় করে, জন্মান্তরে অন্য দেহে তাহার ফল ভোগ করে, এই বা কিরূপ ব্যবস্থা?

উঃ- মৃত্যুর পর জীবের দেহবন্ধনও ঘোচে না, অন্য দেহেও পাপপুণ্যাদি ফলভোগ হয় না, এই দেহই থাকে। দেহ দুইটি (১) স্থূল শরীর, আর (২) সূক্ষ্ম শরীর বা লিঙ্গ শরীর। চর্ম্মচক্ষুতে স্থূল শরীরই দেখা যায়, সূকশম শরীর দেখিতে জ্ঞানচক্ষু চাই। তাই শ্রীভগবান্‌ বলিয়াছেন সূক্ষ্ম শরীর লইয়া জীব কিরূপে যাতায়াত করে এবং পাপপুণ্যাদির ফলভোগ করে তাহা অজ্ঞ লোক দেখিতে পায় না, উহা জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে দর্শন করিয়া থাকেন।

এই দৃশ্য স্থূল শরীর ও অদৃশ্য সূক্ষ্ম শরীর কোন্‌টি কিসের দ্বারা গঠিত?
পূর্ব্বে বলা হইয়াছে, সাংখ্যোক্ত ২৪ তত্ত্ব (প্রকৃত, মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়াদি) দ্বারা এই দেহ গঠিত। তন্মধ্যে ক্ষিতি, অপ্‌, প্রভৃতি পাঁচটি স্থূল পদার্থ, বাকী মহত্তত্ত্ব হইতে পঞ্চতন্মাত্র পর্য্যন্ত ১৮ টি সূক্ষ্ম পদার্থ এবং প্রকৃতি সকলের নির্ব্বিশেষ কারণ-স্বরূপ সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম পদার্থ। ক্ষিত্যাদি পঞ্চ স্থূলভূতদ্বারা নির্ম্মিত যে দেহ তাহাই স্থূল শরীর; মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, দশেন্দ্রিয়, মন ও পঞ্চতন্মাত্র, এই ১৮টি দ্বারা গঠিত দেহ সূক্ষ্ম শরীর, আর সকলের মূল কারণ প্রকৃতিকেই কারণ-শরীর কহে মৃত্যুকালে পঞ্চভূতাত্মক স্থূল শরীরই বিনষ্ট হয়, সূক্ষ্মশরীর লইয়া জীব উৎক্রমণ করে এবং পূর্ব্ব কর্মানুযায়ী নূতন স্থূল-দেহ ধারণ করিয়া ঐ সূক্ষ্ম শরীর লইয়াই পাপপুণ্যাদি ফলভোগ করে এবং এই কারণেই উহার মন, বুদ্ধি, ধর্ম্মাধর্ম্মাদি সংস্কার অর্থাৎ স্বভাব পূর্ব্বজন্মানুযায়ীই হয়; তবে জন্মগ্রহণ কালে পিতামাতার দেহ হইতে লিঙ্গ-শরীর যে দ্রব্য আকর্ষণ করিয়া লয় তাহাতে তাহার দেহ-স্বভাবের ন্যূনাধিক ভাবান্তর ঘটিয়া থাকে। সুতরাং কেবল স্থূলদেহের সংসর্গ লোপ হইলেই মুক্তি হয় না, সূক্ষ্মশরীরও যখন লোপ পায়, তখনই জীবের সত্যস্বরূপ প্রতিভাত হয়।

এস্থলে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মন এই ছয়টিকেই সূক্ষ্মশরীর বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে; ঘ্রাণমেবচ এবং মনশ্চ এই দুই পদের চ-কার দ্বারা বুঝাইতেছে যে, উহার মধ্যেই পঞ্চতন্মাত্র, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, বুদ্ধি ও অহঙ্কারেরও সমাবেশ করিতে হইবে। দ্রষ্টব্য এই, ইন্দ্রিয় বলিতে চক্ষুকর্ণাদি স্থূল ইন্দ্রিয়যন্ত্র বুঝায় না, উহা স্থূলদেহের অন্তর্গত, প্রকৃত ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়-শক্তি সূক্ষ্ম তত্ত্ব।

ইহাই সাংখ্যোক্ত সূক্ষ্মশরীর। বেদান্ত মতে পঞ্চ কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ প্রাণ এবং বুদ্ধি ও মন এই সপ্তদশ অবয়বে সূক্ষ্মশরীর গঠিত। সাংখ্যমতে পঞ্চ প্রাণ একাদশ ইন্দ্রিয়েরই অন্তর্ভূত। আত্মার এই বিভিন্ন আবরণ বা শরীরকে কোষও বলা হয়। কোষ পাঁচটি (১) অন্নময় কোষ; ইহাই পঞ্চভূতাত্মক স্থূল শরীর; (২) মনোময় কোষ (মন ও পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়); (৩) প্রাণময় কোষ (প্রাণ ও পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয়); (৪) বিজ্ঞানময় কোষ (বুদ্ধি ও পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়) এই তিনটি মিলিয়া সূক্ষ্ম শরীর; (৫) আনন্দময় কোষ, ইহাকেই কারণ-শরীর বলে।

মহাভারতে উল্লেখ আছে, যম সত্যবানের শরীর হইতে এক অঙ্গুষ্ঠ পরিমিত পুরুষকে আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিলেন (অঙ্গুষ্ঠমাত্র-পুরুষং নিশ্চকর্ষ যমো বলাৎ)। ইহাই সূক্ষ্মশরীর। যোগিগণ সূক্ষ্মদেহ লইয়া স্থূলদেহ হইতে বহির্গত হইয়া অন্য শরীরে প্রবেশ করিতে পারেন (মহাভারতে জনক-সুলভা সংবাদ ইত্যাদি দ্রষ্টব্য)।

উৎক্রামন্তং স্থিতং বাপি ভূঞ্জানং বাঁ গুণান্বিতম্।
বিমূঢ়া নানুপশ্যন্তি পশ্যন্তি জ্ঞানচক্ষুষঃ।।১০

অর্থঃ- (১০) জীব কিরূপে সত্ত্বাদি গুণসংযুক্ত হইয়া দেহে অবস্থিত থাকিয়া বিষয়সমূহ ভোগ করেন অথবা কিরূপে দেহ হইতে উৎক্রান্ত হন, তাহা অজ্ঞ ব্যক্তিগণ দেখিতে পান না, কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে দর্শন করিয়া থাকেন।

যতন্তো যোগিনশ্চৈনং পশ্যন্ত্যাত্মন্যবস্থিতম্।
যতন্তোহপ্যকৃতাত্মানো নৈনং পশ্যন্ত্যচেতসঃ।।১১

অর্থঃ- (১১) সাধনে যত্নশীল যোগিগণ আপনাতে অবস্থিত এই আত্মাকে দর্শন করিয়া থাকেন, কিন্তু যাহারা অজিতেন্দ্রিয় ও অবিবেকী তাহারা যত্ন করিলেও ইহাকে দেখিতে পায় না।

দেহস্থিত জীব কিরূপে ত্রিগুণের দ্বারা বদ্ধ হইয়া বিষয় ভোগ করেন, অথবা কিরূপে এক দেহ হইতে বহির্গত হইয়া দেহান্তরে প্রবেশ করেন, এই জীব কে, তাহার প্রকৃত স্বরূপ কি এই সকল তত্ত্ব দুর্জ্ঞেয়। কেবল শাস্ত্রাভ্যাসে আত্ম-দর্শম হয় না, যাঁহারা ইন্দ্রিয় জয় করিয়া যোগযুক্ত চিত্তে সাধনা করেন, তাঁহারাই আত্মাকে দর্শন করিতে পারেন। আবিবেকিগণ শাস্ত্রাদি প্রমাণ অবলম্বনে চেস্টহা করিলেও আত্মতত্ত্ব বুঝিতে পারে না। ইহাই পূর্ব্বোক্ত দুই শ্লোকের তাৎপর্য্য।

যদাদিত্যগতং তেজো জগত্ ভাসয়তেহখিলম্।
যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তৎ তেজো বিদ্ধি মামকম্।।১২

অর্থঃ- (১২) যে তেজ সূর্য্যে থাকিয়া সমগ্র জগৎ উদ্ভাসিত করে, এবং যে তেজ চন্দ্রমা ও অগ্নিতে আছে, তাহা আমারই তেজ জানিবে।

এই কয়েকটি শ্লোকে পরমেশ্বরের বিশ্বানুগতা পুনরায় বর্ননা করে হইয়াছে।

গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা।
পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্ব্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ।১৩

অর্থঃ- (১৩) আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া স্বকীয় বলের দ্বারা ভূতগণকে ধারণ করিয়া আছি। আমি অমৃত রসযুক্ত চন্ররূপ ধারণ করিয়া ব্রীহি যবাদি ওষধিগণকে পরিপুষ্ট করিয়া থাকি।

শাস্ত্রে এইরূপ বর্ণনা আছে যে, চন্দ্র জলময় ও সর্ব্বরসের আধার এবং চন্দ্রের এই রসাত্মক গুণেই বনস্পতিগণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।

অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ।
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্ব্বিধম্।।১৪

চতুর্ব্বিধম্‌ অন্নং চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য, পেয় এই চতুর্ব্বিধ খাদ্য।

অর্থঃ- (১৪) আমি বৈশ্বানর (জঠরাগ্নি) রূপে প্রাণিগণের দেহে অবস্থান করি এবং প্রাণ ও অপান বায়ুর সহিত মিলিত হইয়া চর্ব্ব্য চোষ্যাদি চতুর্ব্বিধ খাদ্য পরিপাক করি।

দেহযন্ত্রে একখণ্ড রুটি ফেলিয়া দিলে উহা রক্তে পরিণত হয়। চেহাভ্যন্তরীণ কি কি প্রক্রিয়ার দ্বারা এই পরিপাক ক্রিয়া সাধিত হয় তাহা জড়বিজ্ঞান বলিতে পারে। কিন্তু কোন্‌ শক্তিবলে এই কার্য্য সম্পন্ন হয়, তাহা জড়বিজ্ঞান জানে না। উহা ঐশ্বরিক শক্তি।

সর্ব্বস্য চাহং হ্রদি সন্নিবিষ্টো মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনঞ্চ।
বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্।।১৫

অর্থঃ- (১৫) আমি অন্তর্যামিরূপে সকল প্রাণীর হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছি, আমা হইতেই প্রাণগনের স্মৃতি ও জ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং আমা হইতেই স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপও সম্পাদিত হয়, আমিই দেবসমূহের একমাত্র জ্ঞাতব্য, আমিই আচার্য্যরূপে বেদান্তের অর্থ প্রকাশক এবং আমিই বুদ্ধিতে অধিষ্ঠিত থাকিয়া বেদার্থ পরিজ্ঞান হই।

আত্মবৈতন্য প্রভাবে জীবের স্মৃতি ও জ্ঞানের উদয় হইয়া থাকে এবং যে মোহবশতঃ স্মৃতি ও জ্ঞানের লোপ হয়, সেই মোহও তাহা হইতেই জাত। সমস্ত বেদেই তাহাকে জানিতে উপদেশ করেন। দেবব্যাসাদিররূপে তিনিই বেদার্থ প্রকাশক এবং বেদবেত্তা বা ব্রহ্মবেত্তাও তিনিই, ব্রহ্ম না হইলে ব্রহ্মকে জানা যায় না।

দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ।
ক্ষরঃ সর্ব্বাণি ভূতানি কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে।।১৬

অর্থঃ- (১৬) ক্ষর ও অক্ষর, এই দুই পুরুষ এই লোকে প্রসিদ্ধ আছে। তন্মধ্যে সর্বভূত ক্ষর পুরুষ এবং কুটস্থ অক্ষর পুরুষ বলিয়া কথিত হন।

উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।।১৭

অর্থঃ- (১৭) অন্য এক উত্তম পরমাত্মা বলিয়া কথিত হয়। তিনি লোকত্রয়ে প্রবিষ্ট হইয়া সকলকে পালন করিতেছেন, তিনি অব্যয়, তিনি ঈশ্বর।

যস্মাৎ ক্ষরমতীহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ।
অতোহস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ।।১৮

অর্থঃ- (১৮) যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর হইতেও উত্তম, সেই হেতু আমি লোক-ব্যবহারে এবং বেদে, পুরুষোত্তম বলিয়া খ্যাত।

পুরুষোত্তম-তত্ত্বঃ

এস্থলে তিনটি পুরুষের কথা বলা হইতেছে ক্ষর পুরুষ, অক্ষর পুরুষ ও উত্তম পুরুষ বা পুরুষোত্তম। ইহার কোন্‌টিতে কোন্‌ তত্ত্ব প্রকাশ করে?

শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন ক্ষর পুরুষ সর্ব্বভূত, অক্ষর কুটস্থ পুরুষ এবং আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর হইতেও উত্তম, এই হেতু আমি পুরুষোত্তম।

সাধারণতঃ কুটস্থ অক্ষর বলিতে নির্গুণ নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্বই বুঝায়। গীতায়ও অনেক স্থলেই এই অর্থেই কুটস্থ ও অক্ষর শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে।  এস্থলে কিন্তু বলা হইতেছে, আমি অক্ষর হইতেও উত্তম। উপনিষদে এবং ব্রহ্মসূত্রে ব্রহ্মই অদ্বয় পরতত্ত্ব। ব্রহ্মস্বরূপ কোথায়ও নির্গুণ, কোথায়ও সগুণ, কোথায়ও সগুণ-নির্গুণ উভয়রূপেই বর্ণনা করা হইয়াছে। শ্বেতাশ্বতর প্রভৃতি কোন কোন উপনিষদে, মূল তত্ত্বের বর্ণনায় দেব, ঈশ্বর, পুরুষ প্রভৃতি শব্দও ব্যবহৃত হইয়াছে। ভাগবতশাস্ত্রে উপনিষদের এই দেব, ঈশ্বর বা সগুণ ব্রহ্মই পুরুষোত্তম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব অপেক্ষা ইহাকে শ্রেষ্ঠস্থান দেওয়া হইয়াছে; কেননা ভক্তিমার্গে অনির্দ্দেশ্য, অচিন্ত্য নির্গুণ তত্ত্বের বিশেষ উপযোগিতা নাই। মহাভারতের নারায়ণীয় পর্ব্বাধ্যায়ে (যাহা ভাগবত শাস্ত্রের বা সাত্ত্বত ধর্ম্মের মূল) এই পুরুষোত্তম শব্দ পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে এবং তিনি নির্গুণ হইয়াও গুণধারক, তিনিই অব্যয়, পরমাত্মা, পরমেশ্বর, ইহা স্পষ্টই বলা হইয়াছে। পুরাণাদিতে ভগবান্‌ পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব ও পরব্রহ্ম বলিয়া কীর্ত্তিত এবং অনেক স্থানেই তাঁহার নির্ব্বিশেষ নির্গুণ স্বরূপ অপেক্ষা সবিশেষ সগুণ বিভাবেরই বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হইয়াছে। গীতাও ভাগবত ধর্ম্মেরই গ্রন্থ, উহাতে পুরুষোত্তম বা গভবত্ত্বই পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ স্বরূপ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং উহাতেই ব্রহ্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা, এরূপ বর্ণনাও আছে।

মোট কথা, ব্রহ্মই সমস্ত (সর্বং খল্বিদংব্রহ্ম) এই বৈদান্তিক মূলতত্ত্বই গীতার প্রতিপাদ্য। পূর্ব্বোক্ত তিনি পুরুষ সেই মূল তত্ত্বেরই বিশ্লেষণ। ঐ তিন পুরুষ এক তত্ত্বেরই তিন বিভাব। এই পরিণামী চেতনাচেতনাত্মক জগৎ (সর্ব্বভূতানি) তাহা হইতেই জলবুদ্বুদের ন্যায় উত্থিত হইয়া আবার তাঁহাতেই বিলীন হয়। তাঁহার অপরা ও পরা প্রকৃত সংযোগে উহা সৃষ্ট এবং তাঁহার জীবভূতা পরা প্রকৃতিই উহা ধারণ করিয়া আছে। ইহাই ক্ষরভাব এবং তাঁহার অপরিণামী নির্ব্বিশেষি কুটস্থ নির্গুণ স্বরূপই অক্ষর পুরুষ বা অক্ষর ভাব, আর পুরুষোত্তম ভাবে তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ, সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্ত্তা, যজ্ঞতপস্যার ভোক্তা, সর্ব্বভূতের গতিকর্ত্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ। গীতার মতে, ইহাই তাঁহার শ্রেষ্ঠ সমগ্র স্বরূপ

শ্রীঅরবিন্দ এই তিনটি তত্ত্ব এইরূপ ভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন

"ক্ষর হইতেছে সচল, পরিণামী আত্মার বহুভূত বহু-রূপে যে পরিণাম তাহাকেই ক্ষর পুরুষ বলা হইতেছে। এখানে পুরুষ বলিতে ভগবানের বহুরূপ (Multiplicity of the Divine Being) বুঝাইতেছে এই পুরুষ প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্র নহে, ইহা প্রকৃতিরই অন্তর্গত। অক্ষর হইতেছে অচল, অপরিণামী, নীরব, নিস্ক্রিয় পুরুষ ইহা ভগবানের একরূপ (the Unity of the Divine Being), প্রকৃতির সাক্ষী; কিন্তু প্রকৃতি ও তাহার কার্য্য হইতে এই পুরুষ মুক্ত। পরমেশ্বর, পরব্রহ্ম, পরম পুরুষই উত্তম, উল্লিখিত পরিণামী বহুত্ব ও অপরিণামী একত্ব এই দুই-ই উত্তমের। তাঁহার প্রকৃতির, তাঁহার শক্তির বিরাট ক্রিয়ার বলে, তাঁহার ইচ্ছা ও প্রভাবের বশেই তিনি নিজকে সংসারে ব্যক্ত করিয়াছেন। আবার আরও মহান, নীরবতা ও অচলতার দ্বারা নিজকে স্বতন্ত্র, নির্লিপ্ত রাখিয়াছেন; তথাপি তিনি পুরুষোত্তমরূপে প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্রতা এবং প্রকৃতিতে নির্লিপ্ততা এই দুইয়েরই উপরে। পুরুষোত্তম সন্বন্ধে এইরূপ ধারণা উপনিষদে প্রায়ই সূচিত হইলেও গীতাতেই ইহা স্পস্টভাবে বর্ণিত হইয়াছে এবং তাহার পর হইতে ভারতীয় ধর্মচিন্তার উপর এই ধারণা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। যে সর্ব্বোত্তম ভক্তিযোগ অত্বৈতবাদে কঠিন নিগড় ছাড়াইয়া যাইতে চায়, ইহাই (অর্থাৎ এই পুরুষোত্তমতত্ত্ব) তাহার ভিত্তি; ভক্তিরসাত্মক পুরাণ-সমূহের মূলে এই পুরুষত্তম-বাদ নিহিত রহিয়াছে।"

এই পুরুষোত্তমবাদ দ্বারাই গীতা, জ্ঞান, কর্ম্ম ও ভক্তির সমস্বয় সাধন করিয়াছেন। ব্রহ্মবাদে উহা হয় না, কেননা মায়াবাদিগণের ব্রহ্ম নীরব, অক্ষর, নিস্ক্রিয়; সাংখ্যদিগের পুরুষও তদ্রূপ; সুতরাং আ উভয় মতেই কর্ম্মত্যাগ ভিন্ন মোক্ষলাভের অন্য উপায় নাই এবং এই মোক্ষ বা মিলনে ভক্তিরও স্থান নাই। কিন্তু গীতার পুরুষোত্তম যেমন সম, শান্ত, নির্গুণ, অনন্ত, অখিলাত্মা, আবার তিনিই গুণ-পালকি, গুণ-ধারক, নির্গুণ, অনন্ত, অখিলাত্মা, আবার তিনিই গুণ-পালক, গুণ-ধারক, প্রকৃত বা কর্মের প্রেরয়িতা, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্ব্বলোকমহেশ্বর। সুতরাং সর্ব্বভূতাত্মৈক্য জ্ঞানই পুরুষোত্তমের জ্ঞান, সর্ব্বভূতে প্রীতি ও সেই সর্ব্বশরণে আত্মসমর্পণই পুরুষোত্তমে ভক্ত এবং সর্ব্বলোকসংগ্রাহার্থ নিস্কাম কর্ম্ম পুরুষোত্তমেরই কর্ম্ম (মৎকর্ম্মকৃৎ) এইরূপ জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম্মের মিলনের দ্বারা আত্মা সর্ব্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, - যিনি একই কালে অনন্ত আধ্যাত্মিক শানিত এবং অনন্ত বিশ্বব্যাপী কর্ম্ম উভয়েরই অধীশ্বর সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করেন (স যোগী ময়ি বর্ত্ততে বিশতে তদনন্তরম্‌)। ইহাই গীতার গুহ্য সারতত্ত্ব (গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদং)। ইহাই ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণোক্ত ভাগবত ধর্ম্ম, ইহার অন্তর্নিবিষ্ট সার্ব্বভৌম দার্শনিক তত্ত্ব ও ধর্ম্মনীতি জাতিধর্ম্মনির্ব্বিশেষে মানবমাত্রেরই অধিগম্য। এরূপ উদার সর্ব্বতঃপূর্ণ সর্ব্বাঙ্গসুন্দর ধর্মতত্ত্ব জগতে আর কোথাও প্রচলিত্য হয় নাই।

কিন্তু সকলে গীতার এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন না, বা স্বীকার করেন না। সুতরাং এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় বহু সাম্প্রদায়িক মতভেদ আছে। কেহ বলেন, এস্থলে অক্ষর বলিতে বুঝায় অব্যক্ত প্রকৃতি বা মায়া, আর ক্ষর বলিতে বুঝায় ব্যক্ত জগৎ। আর ব্যক্ত সৃষ্টি ও অব্যক্ত প্রকৃতির অতীত যেব্রহ্ম তিনিই পুরুষোত্তম। কেহ বলেন, - এখানে ক্ষর বলিতে বুঝায় প্রকৃতি এবং অক্ষর বলিতে বুঝায় পুরুষ বা জীবাত্মা এবং উভয়ের অতীত পরব্রহ্মই পুরুষোত্তম। এইমতে শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ১।৮, ১০ মন্তের ক্ষর ও অক্ষর শব্দের অর্থ ইহাই, কিন্তু উহার পূর্ব্বোক্তরূপ ব্যাখ্যাও হয়। কেহ আবার বলেন, অবিদ্যার বহুমূর্ত্তিতে অবস্থিত যে চৈতন্য তিনিই ক্ষর জীব, মায়ার এক মূর্ত্তিতে অবস্থিত যে চৈতন্য তিনি অক্ষর ঈশ্বর এবং মায়াতীত যিনি তিনি পরব্রহ্ম পুরুষোত্তম। এই যে অবিদ্যা ও মায়ার পার্থক্য এবং মায়াতীত ব্রহ্ম হইতে মায়াধীশ ঈশ্বরের গৌণত্ব ইহা পরবর্ত্তীকালীন অদ্বৈত বেদান্তীদিগের একটি মত। গীতায় মায়াঈশ্বর শব্দ ঠিক এ অর্থে কোথাও ব্যবহৃত হয় নাই। এই স্থলেই যাহাকে অক্ষর হইতেও উত্তম বলা হইতেছে তাহাকেই অব্যয় ঈশ্বর বলা হইয়াছে। বস্তুতঃ এইসকল ব্যাখ্যা গ্রহণ করিলে গীতার বিভিন্ন স্থলের পূর্ব্বাপর সঙ্গতি রক্ষা হয় না এবং গীতার ভাষায়ও এরূপ ব্যাখ্যা সমর্থন করে না। এই প্রসঙ্গে এই কয়েকটি কথা বিবেচ্যঃ-

(১) এই স্থলে পূর্ব্বে বলা হইল যে লোকে ক্ষর ও অক্ষর এই দুই পুরুষ আছে। উহা কি? দ্বিতীয় মুণ্ডকে রূপকের ভাষায় দুই পুরুষের বর্ণনা আছে স্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিযস্বজাতে দুইটি সুন্দর পক্ষী (জীব ও ব্রহ্ম) একই বৃক্ষে (দেহে) অধিষ্ঠিত আছে, তাহারা পরস্পর সখা। শ্বেতাশ্বতরে এই তত্ত্ব লক্ষ্য করিয়াই বলা হইয়াছে, "জ্ঞাজ্ঞৌ দ্বৌ ঈশানীশৌ" একজন অজ্ঞ, একজন প্রাজ্ঞ, একজন অনীশ, একজন ইশ। এই উপনিষদেই অন্যত্র একটি ত্রিবর্ণা অজা (ত্রিগুণা প্রকৃতি) ও দুইটি অজ পুরুষের (জীব ও ব্রহ্ম) কথা আছে। মহাভারতেও চারিটি অধ্যায়ে ক্ষরাক্ষরের সুদীর্ঘ বিচার আছে। তথায় অক্ষর বলিতে অপরিণামী নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব এবং ক্ষর পরিণামী, প্রকৃতি-জড়িত জীবতত্ত্বই বুঝান হইয়াছে। সুতরাং দেখা যায়, জীব বা প্রকৃতিকে অক্ষর পুরুষ কোথায়ও বলা হয় নাই। গীতায়ও অক্ষরকুটস্থ, সর্ব্বত্রই ব্রহ্মবস্তু বুঝাইতেই ব্যবহৃত হইয়াছে।

(২) এস্থলে বলা হইতেছে, অক্ষর হইতেও (অপি) আমি উত্তম। প্রকৃতি হইতে পরমেশ্বর উত্তম, - একথা বলিতে অপির প্রয়োজন হয় না, উহা সর্ব্ববাদিসম্মত। কিন্তু যাহাকে পরতত্ত্ব, অক্ষর ব্রহ্ম বলা হয়, তাহা হইতেও উত্তম এই বৈশিষ্ট্য প্রকাশার্থ অপি ব্যবহৃত হইয়াছে। নচেৎ অপির কোন অর্থ হয় না।

(৩) পরে বলা হইতেছে যে, ইহা অতি গুহ্যতম শাস্ত্র। 'যে আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানে, সে আমাকে সর্ব্বভাবে ভজনা করে, ইত্যাদি।'পরব্রহ্ম প্রকৃতি হইতে উত্তম বা নশ্বর জগৎ প্রপঞ্চের অতীত, ইহাই যদি এস্থলে বলার উদ্দেশ্য হয়, তবে এ তত্ত্ব এমন গুহ্যতম হইল কিসে? আর আমাকে 'সর্ব্বতোভাবে ভজনা করে', অদ্বৈত ব্রহ্মতত্ত্বে একথারই বা সার্থকতা কি? প্রকৃত কথা হইতেছে এই, উপনিষদের ব্রহ্মবাদ পূর্ব্বাবধিই সুপ্রচলিত ছিল, উহার সহিত নিস্কাম কর্ম্ম ও ভক্তির সংযোগ করিয়া যে ভাগবত ধর্ম্মের প্রচার হয়, তাহাতে পুরুষোত্তমই উপনিষদের ব্রহ্মের স্থান অধিকার করেন। এই ধর্ম্ম পূর্ব্বে অনেকবার প্রাদুর্ভূত হইয়াও অন্তর্হিত হইয়াছে এবং এই ধর্ম্মই শ্রীভগবান্‌ অর্জ্জুনকে বলিতেছেন, একথা গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে এবং মহাভরতের অন্যত্রও স্পস্টতঃ আছে এবং ভাগবতেও 'ইহাকে মদ্ধর্ম্ম' বলিয়া উল্লেখ করিয়া 'তুমি ইহা অভক্তকে বলিবে না', শ্রীভগবান্‌ ভক্ত উদ্ধবকে এইরূপ উপদেশ দিয়াছেন। মহাভারতীয় নারায়ণীয় পর্ব্বাধ্যায়ে এই পুরুষোত্তম তত্ত্ব ও ভাগবত ধর্ম্মের বিস্তারিত বর্ণনা আছে। তথায়ও ইহাকে 'সর্ব্ব-শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ', 'উত্তম রহস্য' ('শাস্ত্রাণাং শাস্ত্রমুত্তমম্‌', 'রহস্যঞ্চৈতদুত্তমম্‌' শাং), 'অভক্তকে অদেয়' ('নাবাসুদেবভক্তায় ত্বয়া দেয়ং কথঞ্চন') ইত্যাদি বলা হইয়াছে। এস্থলেও সেই মহাভারতীয় পুরুষোত্তম তত্ত্বই বর্ণিত হইয়াছে এবং ইহাকেই নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব হইতেও উত্তম বলা হইয়াছে। পুরুষোত্তম পরব্রহ্মই বটেন, কিন্তু উপনিষদের ব্রহ্মতত্ত্বে অবতারবাদ ও ভক্তির প্রসঙ্গ নাই। ভাগবতধর্ম্মে ঐ দুইটির প্রাধান্য থাকাতেই পুরুষোত্তম তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য জন্মিয়াছে। ইহাই 'উত্তম রহস্য'।

(৪) পুরুষোত্তমতত্ত্বের এই বৈশিষ্ট্য স্বীকার না করিলে গীতার অন্যান্য স্থলেরও অর্থসঙ্গতি হয় না। শ্রীভগবান্‌ ১৪।৫৪ শ্লোকে বলিতেছেন, 'ব্রহ্মভাব লাভ করিলে আমাতে ভক্তি জন্মে এবং ভক্তিদ্বারা তত্ত্বতঃ জানিয়া আমাতে প্রবেশ করা যায়', আবার অন্যত্র ব্রহ্মনির্ব্বাণ বা আত্মদর্শন লাভ করার পরও ভগবদ্দর্শনের প্রয়োজনীয়াতার উল্লেখ করিতেছেন। নির্গুণ ব্রহ্মই পরতত্ত্ব এবং ব্রাহ্মী স্থিতিই গীতার শেষ কথা হইলে এই সকল শ্লোকের কোনও অর্থ হয় না। বস্তুতঃ নির্গুণ-গুণী পুরুষোত্তমই যে পরতত্ত্ব এবং অনির্দ্দেশ্য ব্রহ্মতত্ত্ব হইতেও উত্তম, এ সকল শ্লোক এই মর্ম্মেরই পরিপোষক।

আবার কেহ কেহ বলেন যে শ্রীগীতার এই শ্লোকগুলি যে স্থলে শ্রীভগবান্‌ আপনাকে অক্ষর পুরুষ হইতেও উত্তম বা পুরুষোত্তম বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, - তাহা প্রক্ষিপ্ত। ইহারা বলেন

"গীতার পুরুষোত্তমবাদ একটি বৈষ্ণব মত। ইহা বৈদান্তিক মত নহে। এই অংশকে প্রক্ষিপ্ত বলিলে গীতার মৌলিক মতের কোন ব্যত্যয় ঘটে না, গীতার অন্য কোন মত এই অংশের উপর নির্ভর করে না। এই অংশ প্রক্ষিপ্ত করিবার উদ্দেস্য বৈষ্ণব মত প্রচায়" স্বর্গত মহেশচন্দ্র ঘোষ, প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩৩৫।

ইহা বৈষ্ণব মত এ কথা ঠিক। তবে বৈষ্ণবগণ বলেন, শ্রীগীতাও বৈষ্ণব গ্রন্থ, ভাগবত ধর্ম্ম বা সাত্ত্বত ধর্ম্মের মূল গ্রন্থ (ভূমিকা দ্রষ্টব্য)। ইহা কেবল নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্ব-প্রতিপাদক বৈদান্তিক গ্রন্থ নহে। ইহা ব্রহ্মবিদ্যার অন্তর্গত (কর্ম্ম) যোগশাস্ত্র। ব্রহ্মজ্ঞান, নিষ্কাম কর্ম্ম ও ঐকান্তিক ভগবদ্ভক্তির সমুত্তয় মূলে অপূর্ব্ব যোগধর্ম্মের প্রচারই ইহার বিশেষত্ব। ইহাই ভাগবত ধর্মের প্রাচীন স্বরূপ এবং এই ধর্ম প্রচারই গীতার উদ্দেশ্য।

কর্ম্ম-জ্ঞান-ভক্তির সমুচ্চয়ই গীতার মূল প্রতিপাদ্য এ কথা স্বীকার করিলে ইহাও স্বীকার করিতে হয় যে, এই পুরুষোত্তমবাদ বা ঈশ্বরবাদের উপরই এই সমুচ্চয়বাদ সম্পূর্ণ নির্ভর করে। কারণ, বেদান্তের অনির্দ্দেশ্য, নির্গুণ নিষ্ক্রিয় ব্রহ্মভাবে কর্ম্ম ও ভক্তির স্থান নাই। এই হেতুই গীতা, ভাগবত প্রভৃতি সাত্ত্বত-ধর্ম্ম শাস্ত্রে নিষ্ক্রিয় অক্ষর ব্রহ্ম অপেক্ষা ক্রিয়াশীল, 'ভক্তের ভগবান্‌', 'নির্গুণ-গুণী' ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য। ইনিই পুরুষোত্তম। সুতরাং গীতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে দৃষ্টি রাখিলে এ সকল শ্লোক প্রক্ষিপ্ত তো নহেই, বরং বিশেষ প্রয়োজনীয় বলিয়াই বোধ হয়।

মায়াবাদিগণের ব্রহ্ম নীরব, অক্ষর, নিষ্ক্রিয়, সাংখ্যদের পুরুষও তদ্রূপ। ভগবান্‌ যদি শুধু এই অক্ষর আত্মা হন এবং তাহা হইতে যে সত্ত্বা প্রকৃতির খেলায় বাহির হইয়াছে তাহাই যদি জীব হয়, তাহা হইলে যে মুহূর্ত্তে জীব ফিরিয়া আসিবে ও আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইবে তখনই সমস্ত বদ্ধ হইয়া যাইবে, কেবল থাকিবে পরম ঐক্য, পরম নিস্তব্ধতা। - তাহা হইলে সর্ব্বাপেক্ষা ভীষণ ও ধ্বংসসঙ্কুল কর্ম্ম করিতে পুনঃ পুনঃ আদেশ কেন, এই রথ কেন, এই যুদ্ধ কেন, এই যোদ্ধা কেন, এই দিব্য সারথি কেন? গীতা এই বলিয়া জবাব দিয়াছেন যে, ভগবান্‌ অক্ষর আত্মা অপেক্ষাও বড়, আরও অধিক ব্যাপক, তিনি একাধারে অক্ষর ব্রহ্ম বটেন আবার প্রকৃতির কার্য্যের অধীশ্বরও বটেন। - জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম্মের মিলনের দ্বারা আত্মার সর্ব্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যিনি এক কালে অনন্ত আধ্যাত্মিক শান্তি এবং অনন্ত্য বিশ্বব্যাপী কর্ম্ম উভয়েরই অধীশ্বর সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করে। ইহাই গীতার সমন্বয় অরবিন্দের গীতা।

যো মামেবমসংমূঢ়ো জানাতি পুরুষোত্তমম্।
স সর্ব্ববিদ্ ভজতি মাং সর্ব্বভাবেন ভারত।।১৯

অর্থঃ- (১৯) হে ভারত, যিনি মোহযুক্ত হইয়া এই ভাবে আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিতে পারেন, তিনি সর্ব্বজ্ঞ হন এবং সর্বতোভাবে আমাকে ভজনা করেন।

'তিনি সর্ব্বজ্ঞ হন' অর্থাৎ আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিলে আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না, সগুণ-নির্গুণ, সাকার-নিরাকার, দ্বৈতাদ্বৈত ইত্যাদি সংশয় আর তাহার উপস্থিত হয় না। তিনি জানেন, আমিই নির্গুণ পরব্রহ্ম, আমিই সগুণ বিশ্বরূপ, আমিই সর্ব্বলোক-মহেশ্বর, 'আমিই লীলার অবতার, আমিই হৃদয়ে পরমাত্মা, সুতরাং তিনি সকল ভাবেই আমাকে ভজনা করেন।'

ইতি গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদমুক্তং ময়ানঘ।
এতদ্ বুদ্ধ বুদ্ধিমান্ স্যাৎ কৃতকৃত্যশ্চ ভারত।।২০

অর্থঃ- (২০) হে নিষ্পাপ, আমি এই অতি গুহ্য কথা তোমাকে কহিলাম, যে কেহ ইহা জানিলে জ্ঞানী ও কৃতকৃত্য হয়। (অতএব তুমিও যে কৃতার্থ হইবে তাহাতে সন্দেহ কি?)।

পঞ্চদশ অধ্যায় বিশ্লেষণ ও সার-সংক্ষেপ
সংসার-বৃক্ষঃ পুরুষোত্তম তত্ত্ব

পূর্ব্ব অধ্যায়ের শেষে শ্রীভগবান্‌ বলিয়াছেন যে, যে আমাকে অনন্যভাবে ভজনা করে, সে ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়। ত্রিগুণাতীত হওয়ার অর্থ সংসারের মায়াপ্রপঞ্চ অতিক্রম করা, ইহাকেই সংসার-ক্ষর বলেন। এই কথাটি আরও স্পষ্টিকৃত করিবার উদ্দেশ্যেই এই অধ্যায়ে প্রথমতঃ সংসার কি, উহার মূল কোথায়, জীবের জন্ম ও উৎক্রান্তি কিরূপে হয় ইত্যাদি বর্ণনা করিয়া পরিশেষে ভগবান্‌ পুরুষোত্তমরূপে আত্ম-পরিচয় দিয়া বলিতেছেন যে, উহাই পরতত্ত্ব এবং তাঁহাকে পুরুষোত্তমরূপে জানিলেই জীব কৃতার্থ হয় ও সর্ব্বতোভাবে তাঁহার ভজনা করে।

সংসার-বৃক্ষঃ এই সংসার অশ্বত্থ বৃক্ষস্বরূপ। উহার প্রধান মূল ঊর্দ্ধদিকে (পরব্রহ্ম); উহার শাখাসমূহ আধোদিকে বিস্তৃত (দেবাদি যোনি ও পশ্বাদি যোনিতে জীবজন্ম); বেদসমূহ উহার পত্র-স্বরূপ (ধর্মাধর্ম্ম প্রতিপাদন দ্বারা পত্রের ন্যায় রক্ষক স্বরূপ); শব্দস্পর্শাদি বিষয়সমূহ উহার প্রবাল বা তরুণ পল্লবস্থানীয়; উহার বাসনারূপ অবান্তর মূলসকল ধর্ম্মাধর্ম্মরূপ কর্ম্মের প্রসূতি। মায়াবদ্ধ জীব ইহার প্রকৃত স্বরূপ জানে না, বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রদ্বারা মায়াবন্ধন ছেদন করিয়া সংসার প্রবৃত্তির আদি কারণ পরমেশ্বরের পরমপদ অন্বেষণ করা কর্ত্তব্য। অভিমান, আসক্তি, কামনা ও সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব হইতে মুক্ত হইলে সেই পরমপদ লাভ হয়। সেই অব্যয় পদ প্রাপ্তি হইলে আর সংসারে প্রত্যাবর্ত্তন করিতে হয় না।

জীবের জন্মকর্ম্মঃ শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন, জীব আমারই সনাতন অংশ। উহা কর্ম্মফলে সদসদ্‌যোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়া সুখদুঃখাদি ভোগ করেন। উহা দেহত্যাগ কালে সূক্ষ্ম শরীর লইয়া উৎক্রান্ত হয় এবং স্বকর্ম্মানুযায়ী নূতন স্থূল শরীর ধারণ করিয়া ঐ সূক্ষ্ম শরীর লইয়াই পুনরায় বিষয়সমূহ ভোগ করিতে থাকে। জীবের এই জন্মকর্ম্মতত্ত্ব অজ্ঞ ব্যক্তিগণ বুঝিতে পারে না, কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে উহা দর্শন করিয়া থাকেন।

আমিই সর্ব্বকারণের কারণঃ চন্দ্রসূর্য্যাদি সমস্তই আমার সত্তায় সত্তাবান্‌, আমার শক্তিতে শক্তিমান্‌। আমিই পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া ভূতগণকে ধারণ করিয়া আছি। আমার শক্তিতেই ওষধিসমূহ পরিপুষ্ট হইয়া থাকে। আমি জঠরাগ্নিরূপে দেহ রক্ষা করি, আমিই অন্তর্য্যামিরূপে সর্ব্বজীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছি। আমিই বেদসমূহে একমাত্র জ্ঞাতব্য, এবং আমিই আচার্য্যরূপে বেদান্তের অর্থ-প্রকাশক।

আমিই পরতত্ত্ব পুরুষোত্তমঃ লোকে ক্ষর (সর্ব্বভূত, প্রাকৃতি-জড়িত জীব) ও অক্ষর (কূটস্থ, নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব) এই দুই পুরুষ প্রথিত আছে, আমি ক্ষরের অতীত এবং কূটস্থ হইতেও উত্তম, এই হেতু আমি পুরুষোত্তম বলিয়া খ্যাত। আমাকে পুরুষোত্তমরূপে জানিলে আর কিছুই জানিবার অবশিষ্ট থাকে না। তখন জীব বুঝিতে পারে যে, আমি নির্গুণ, আমিই সগুণ, আমিই বিশ্বরূপ, আমিই অবতার, আমিই আত্মা। এই পুরুষোত্তমতত্ত্ব অতি গুহ্য। ইহা জানিলে জীব কৃতকৃত্য হয়; সে সর্ব্বতোভাবে আমাকে ভজনা করে।

এই অধ্যায়ে প্রধান আলোচনার বিষয় পুরুষোত্তমতত্ত্ব। এই হেতু ইহাকে পুরুষোত্তমযোগ কহে।


ইতি শ্রীমদ্‌ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে পুরুষোত্তমযোগো নাম পঞ্চদশোহধ্যায়ঃ। 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : চতুর্দ্দশোহধ্যায় (শ্লোক অর্থসহ)

শ্রীভগবানুবাচ

পরং ভূয়ঃ প্রবক্ষ্যামি জ্ঞানানাং জ্ঞানমুত্তমম্।
যজ্ জ্ঞাত্বা মুনয়ঃ সর্ব্বে পরাং সিদ্ধিমিতো গতাঃ।।১

অর্থঃ-(১) শ্রীভগবান্‌ কহিলেন,- আমি পুনরায় জ্ঞানসমূহের মধ্যে সর্ব্বোত্তম জ্ঞান বলিতেছি, যাহা জানিয়া মুনিগণ এই দেহবন্ধন হইতে মোক্ষ লাভ করিয়াছেন।

পূর্ব্ব অধ্যায়ে বলা হইয়াছে, সকল কর্ত্তৃত্বই প্রকৃতির, পুরুষ অকর্ত্তা। প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের সদসদ্‌যোনিতে জন্ম ও সুখদুঃখ ভোগ অর্থাৎ সংসারিত্ব। এই গুণ কি কি, উহাদের লক্ষণ কি, উহারা কি ভাবে জীবকে আবদ্ধ করে্‌ কিরূপে প্রকৃতি হইতে বিবিধ সৃষ্টি হয়, ইত্যাদি বিষয় বিস্তারিত কিছুই বলা হয় নাই। সেই হেতু এই প্রকৃতিতত্ত্ব বা ত্রিগুণ তত্ত্বই আবার বলিতেছেন। এই হেতুই 'ভূয়ঃ' অর্থাৎ পুনরায় শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে।

ইদং জ্ঞানমুপাশ্রিত্য মম সাধর্ম্ম্যমাগতাঃ।
সর্গেহপি নোপজায়ন্তে প্রলয়ে ন ব্যথন্তি চ।।২

সাধর্ম্ম্য স্বরূপতা অর্থাৎ আমি যেমন ত্রিগুণাতীত এইরূপ ত্রিগুণাতীত অবস্থা।

অর্থঃ-(২) এই জ্ঞান আশ্রয় করিয়া যাহারা আমার সাধর্ম্ম্য লাভ করেন অর্থাৎ ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন, তাঁহারা সৃষ্টিকালেও জন্মগ্রহণ করেন না, প্রলয়কালেও ব্যথিত হন না (অর্থাৎ জন্মমৃত্যু অতিক্রম করেন)।

মম যোনির্মহদ্ ব্রহ্ম তস্মিন্ গর্ভং দধাম্যহম্।
সম্ভবঃ সর্ব্বতভূতানাং ততো ভবতি ভারত।।৩

অর্থঃ-(৩) হে ভারত, প্রকৃতিই আমার গর্ভাধান-স্থান। আমি তাহাতে গর্ভাধান করি, তাহা হইতেই সর্ব্বভূতের উৎপত্তি হয়।

সর্ব্বযোনিষু কৌন্তেয় মূর্ত্তয়ঃ সম্ভবন্তি যাঃ।
তাসাং ব্রহ্ম মহদ্ যোনিরহং বীজপ্রদঃ পিতা।।৪

মহদ্‌ব্রহ্ম অর্থ প্রকৃতি; 'গর্ভাধন করি' অর্থ এই সর্ব্বভূতের জন্মকারণ স্বরূপ বীজ প্রকৃতিরূপ যোনিতে আধান করি। তাৎপর্য্য এই যে, ভূতগণকে তাহাদের স্বীয় প্রাক্তন কর্ম্মানুরূপ ক্ষেত্রের সহিত সংযোজিত করি। এই সংযোজনই গর্ভাধান। অথবা প্রকৃতিতে আমার সংকল্পিত বীজ আধান করি অর্থাৎ আমার সংকল্পানুসারেই প্রকৃতি সৃষ্টি করে। প্রকৃতপক্ষে, ঈশ্বরের সৃষ্টি-সঙ্কল্পই গর্ভাধানস্বরূপ। প্রকৃতির স্বতন্ত্র সৃষ্টি-সামর্থ্য নাই।

অর্থঃ-(৪) হে কৌন্তেয়, দেবমনুষ্যাদি বিভিন্ন যোনিতে যে সকল শরীর উৎপন্ন হয়, প্রকৃতি তাহাদের মাতৃস্থানীয়া এবং আমিই গর্ভাধানকর্ত্তা পিতা।

এই গর্ভাধান কি তাহা পূর্ব শ্লোকে বলা হইয়াছে। বেদান্তে ইহাকেই ঈক্ষণ বলে।

সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ।
নিভধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়ম্।।৫

অর্থঃ-(৫) হে মহাবাহো, সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ, প্রকৃতিজাত এই গুণত্রয় দেহমধ্যে অব্যয় আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে।

জীবাত্মা অবিকারী হইলেও প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃ দেহাত্মভাব প্রাপ্ত হওয়ার সুখ-দুঃখ মোহাদিতে জড়িত হইয়া পড়েন। ৫।৬।৭।৮ এই চারিটি শ্লোকে ত্রিগুণের বন্ধ অর্থাৎ প্রকৃতি-সংযোগে পুরুষের সংসারবন্ধন বর্ণনা হইতেছে।

তত্র সত্ত্বং নির্ম্মলত্বাৎ প্রকাশকমনাময়ম্।
সুখসঙ্গেন বধ্নাতি জ্ঞানসঙ্গেন চানঘ।।৬

অর্থঃ-(৬) হে অনদ, এই তিন গুণের মধ্যে সত্ত্বগুণ নির্ম্মল বলিয়া প্রকাশক এবং নির্দ্দোষ; এই সত্ত্বগুণ সুখসঙ্গ ও জ্ঞানসঙ্গ-দ্বারা আত্মাকে বন্ধন করিয়া রাখে।

সত্ত্বগুণের বন্ধন কিরূপ সত্ত্বগুণের মুখ্য ধর্ম্ম দুইটি, সুখ ও জ্ঞান। এই সুখ ও জ্ঞানকেও বন্ধনের কারণ বলা হইতেছে। এই সুখ বলিতে আত্মানন্দ বুঝায় না। সুখ-দুঃখাদি ক্ষেত্রের ধর্ম্ম, দেহ-ধর্ম্ম, উহা আত্মার ধর্ম্ম নহে, সুতরাং অবিদ্যা (১৩।৬) (ইচ্ছাদি ধৃত্যন্তং ক্ষেত্রস্যৈব বিবরস্য ধর্ম্ম ইত্যুক্তং ভগবতে সৈয্য অবিদ্যা শঙ্কর); আর এই জ্ঞান, আত্মজ্ঞান নহে। বস্তুতঃ সত্ত্বগুণের দ্বিবিধ প্রকারভেদ আছে (১) মিশ্রসত্ত্ব অর্থাৎ রজস্তমো মিশ্রিত সত্ত্ব এবং (২) শুদ্ধ সত্ত্ব অর্থাৎ রজন্তমোবর্জিত সত্ত্ব। এস্থলে সত্ত্বাদি তিনটি গুণের পৃথক্‌ পৃথক্‌ লক্ষণ বর্ণিত হইলেও উহারা পৃথক্‌ থাকে না, সর্ব্বদা এক সঙ্গেই থাকে, এই এক সঙ্গে থাকা কালে অপর দুইটিকে অভিভূত করিয়া সত্ত্বগুণ প্রবল হইলে যে লক্ষণ উপস্থিত হয় উহাই মিশ্র সত্ত্বের লক্ষণ। উহা উচ্চ অবস্থা হইলেও মোক্ষদায়ক নহে, কেননা উহাতে রজঃ ও তমঃ মিশ্রিত থাকায় 'আমি জ্ঞানী' ইত্যাদি আত্মাভিমান থাকে, উহাও ত্রৈগুণ্যের অবস্থা, মোক্ষের অবস্থা নহে।

ত্রিগুণের বর্ণনায় অবশ্য তামসিক, রাজসিক ও সাত্ত্বিক এই ত্রিবিধ অবস্থাই পৃথক্‌ ভাবে বর্ণনা করিতে হয় এ সকলই বদ্ধাবস্থা, ইহার অতীত ত্রিগুণাতীত অবস্থাই মোক্ষাবস্থা। শ্রীভাগবতে এই হেতুই ভক্তিতত্ত্ববর্ণন-প্রসঙ্গে তামসিক, রাজসিক, সাত্মিক এই ত্রিবিধ ভক্তির লক্ষণ বর্ণনা করিয়া পরে নির্গুণা ভক্তির বর্ণনা করা হইয়াছে এবং সে স্থলে ইহাও বলা হইয়াছে যে এই নির্গুণ ভক্তির উৎকর্ষাবস্থায় ভেদজ্ঞান বিদূরিত হয়, তখন ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়া জীব ভাগবত জীবন বা ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয় - 'যেনাতিব্রজ্য ত্রিগুণং মদ্ভাবায়োপপদ্যতে'(ভাঃ ৩।২৯।৭ ১৪)। সেইরূপ গীতাতেও তমঃ রজঃ, সত্ত্ব এই ত্রিগুণকে পৃথক্‌ভাবে বন্ধনের কারণ বলিয়া পরে অধ্যায়ের শেষে ত্রিগুণাতীত অবস্থার বর্ণনায় অহৈতুকী নির্গুণা ভক্তিদ্বারাই ব্রহ্মভাব লাভ হয় এই কথাই বলা হইয়াছে। কিন্তু গীতাতে অনেক স্থলেই বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের অবস্থাকেই ত্রিগুণাতীত অবস্থা বলিয়া গ্রহণ করা হইয়াছে, যেমন ১৮।২০ শ্লোকে সাত্ত্বিক জ্ঞানের যে বর্ণনা উহা প্রকৃতপক্ষে সিদ্ধাবস্থার বর্ণনা। বস্তুতঃ ত্রিগুণাতীতের অবস্থার যে লক্ষণ উহাই রজস্তমোবর্জ্জিত বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণের লক্ষণ এবং উহাই হইতেছে বির্দ্বন্দ্বভাব, বিমল সদানন্দ এবং অপরোক্ষ আত্মানুভূতির অবস্থা। গীতায় নিস্ত্রৈগুণ্য বা ত্রিগুণাতীত বলিতে 'নিত্য শুদ্ধসত্ত্বগুণাশ্রিত'বুঝায়, এই হেতুই ২।৪৫ শ্লোকে শ্রীভগবান্‌ অর্জ্জুনকে 'নিস্ত্রৈগুণ্য' হইতে বলিয়াও 'নিত্যসত্ত্বস্থ' হইতে বলিয়াছেন। পূর্ব্বোক্ত কথাগুলি অনুধাবন করিলেই একই সত্ত্বগুণকে অনেক স্থলেই মোক্ষের কারণ এবং ১৪।৬ শ্লোকে বন্ধনের কারণ কেন বলা হইতেছে তাহা বুঝা যাইবে।

শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য 'বিবেকচুড়ামণি'তে এই দ্বিবিধ সত্ত্বগুণের লক্ষণ ও পার্থক্য স্পষ্ট উল্লেখ করিয়াছেন। যথা, শুদ্ধ সত্ত্বের লক্ষণ
       বিশুদ্ধসত্ত্বস্য গুণাঃ প্রসাদঃ স্বাত্মানুভূতিঃ পরমা প্রশান্তিঃ।
       তৃপ্তিঃ প্রহর্ষ: পরমাত্মনিষ্ঠা যয়া সদানন্দরসং সমৃচ্ছতি।।
এ শ্লোকের মর্ম্ম এই যে বিশুদ্ধ সত্ত্বের ধর্ম্ম দুইটি (১) আত্মজ্ঞান (আত্মানুভূতি, পরমাত্মনিষ্ঠা); (২) আত্মানন্দ (প্রসাদ, প্রশান্তি, তৃপ্তি, প্রহর্ষ সদানন্দ)।
মিশ্রসত্ত্বের লক্ষণ
       'সত্ত্বং বিশুদ্ধং জলবৎ তথাপি
তাভ্যাং মিলিত্বা সরণায় কল্পতে।'
'মিশ্রস্য সত্ত্বস্য ভবন্তি ধর্মাঃ স্বমানিতাদ্যা নিয়মা যমাদ্যাঃ
শ্রদ্ধা চ ভক্তিশ্চ মুমুক্ষতা চ দৈবী চ সম্পত্তরসন্নিবৃত্তঃ।।'

এ কথার মর্ম্ম এই যে সত্ত্বগুণ জলের ন্যায় নির্ম্মল হইলেও অপর দুইটির সহিত মিশ্রিত থাকায় উহা বন্ধনের কারণ হয়। এইরূপ মিশ্র সত্ত্বের লক্ষণ কর্ত্তৃত্বাভিমান, যমনিয়মাদি, শ্রদ্ধা, ভক্তি, মুমুক্ষুতা, শমদমাদি দৈবী সম্পদ্‌ অনিত্য বস্তুতে বিরাগ। মূল কথা এই মিশ্রসত্ত্ব মুমুক্ষুর সাধনাবস্থার লক্ষণ; শুদ্ধসত্ত্ব, মুক্তের সিদ্ধাবস্থার লক্ষণ।

"সত্ত্বগুণের খুব প্রাধান্য হইলেও তাহা প্রকৃত স্বাধীনতার অবস্থা নহে (উহাও বন্ধনের অবস্থা)। কারণ গীতা দেখাইয়াছেন যে অন্যান্য গুণের ন্যায় সত্ত্বও বন্ধন করে এবং অন্যান্য গুণের ন্যায়ই বাসনা ও অহঙ্কারের দ্বারাই বন্ধন করে। সত্ত্বের বাসনা মুত্তর, সত্ত্বের অহঙ্কার শুদ্ধতর, কিন্তু যতদিন এই দুইটি বাসনা ও অহঙ্কার যে কোন আকারে জীবকে ধরিয়া থাকে, ততদিন কোন স্বাধীনতা নাই। যে মানুষ সাধু, জ্ঞানী, তাঁহার ভিতর সাধুর 'অহং' রহিয়াছে এবং তিনি এই সাত্ত্বিক অহঙ্কারের তৃপ্তি করিতে চান। প্রকৃত স্বাধীনতা, চরম স্বরাজ্য তখন আরম্ভ হইবে যখন প্রাকৃত আত্মার উপরে আমরা পরমাত্মাকে দেখিতে পাইব, ধরিতে পারিব; আমাদের ক্ষুদ্র 'আমি' আমাদের অহঙ্কার এই পরমাত্মাকে দেখিতে দেয় আন। ইহার জন্য আমাদিগকে গুণত্রয়ের বহু ঊর্দ্ধে উঠিতে হইবে, ত্রিগুণাতীত হইতে হইবে, কারণ পরমাত্মা সত্ত্বগুনেরও উপরে। আমাদিগকে সত্ত্বের ভিতর দিয়াই উঠিতে হইবে বটে, কিন্তু যতক্ষণ আমরা সত্ত্বকে ছাড়াইয়া যাইব ততকশণ সেখানে পৌঁছিতে পারিব না। কেবল তখনই আমরা নিশ্চিন্ত হইয়া তাঁহাতে বাস করিতে পারি যখন আমাদের সমস্ত বাসনা দূর হইয়া গিয়াছে।" শ্রীঅরবিন্দের গীতা (অনিলবরণ)।

রজো রাগাত্মকং বিদ্ধি তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবম্।
তন্নিবধ্নাতি কৌন্তেয় কর্ম্মসঙ্গেন দেহিনম্।।৭

তৃষ্ণাসঙ্গসমুদ্ভবং তৃষ্ণা অপ্রাপ্তেহর্ষহভিলাষঃ সঙ্গঃ প্রাপ্তেহর্থে প্রীতি তয়োঃ সমুদ্ভবো যস্মাৎ তৎ (শ্রীধর) তৃষ্ণা অপ্রাপ্ত বস্তুতে অভিলাষ; সঙ্গ প্রাপ্ত বস্তুতে প্রীতি বা আসক্তি, এই উভয় যাহা হইতে উৎপন্ন হয়।

অর্থঃ-(৭) হে অর্জ্জুন, রজোগুণ রাগাত্মক; তৃষ্ণা ও আসক্তি উহা হইতে উৎপন্ন হয়। উহা কর্ম্মশক্তি দ্বারা দেহীকে বন্ধন করে।

তমস্ত্বজ্ঞানজং বিদ্ধি মোহনং সর্ব্বদেহিনাম্।
প্রমাদালস্যনিদ্রাভিস্তন্নিবধ্নাতি ভারত।।৮

অর্থঃ-(৮) হে ভারত, তমোগুণ অজ্ঞানজাত এবং দেহীগণের ভ্রান্তিজনক। ইহা প্রমাদ (অনবধানতা), আলস্য ও নিদ্রা (চিত্তের অবসাদ) দ্বারা জীবনকে আবদ্ধ করে।

সত্ত্বং সুখে সঞ্জয়তি রজঃ কর্ম্মণি ভারত।
জ্ঞানমাবৃত্য তু তমঃ প্রমাদে সঞ্জয়ত্যুত।।৯

অর্থঃ-() হে ভারত, সত্ত্বগুণ সুখে এবং রজোগুণ কর্ম্মে জীবকে আসক্ত করে। কিন্তু তমোগুণ জ্ঞানকে আবৃত করিয়া প্রমাদ (কর্ত্তব্যমূঢ়তা বা অনবধাবতা) উৎপন্ন করে।

রজস্তমশ্চাভিভূয় সত্ত্বং ভবতি ভারত।
রজঃ সত্ত্বং তমশ্চৈব তমঃ সত্ত্বং রজস্তথা।।১০

অর্থঃ-(১০) হে ভারত, সত্ত্বগুণ রজঃ ও তমোগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়, রজোগুণ তমঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এবং তমোগুণ রজঃ ও সত্ত্বগুণকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয়।

এই তিন গুণ কখনো পৃথক্‌ পৃথক্‌ থাকে না, তিনটি একত্রই থাকে। কিন্তু জীবের পূর্ব্ব কর্ম্মানুরূপ অদৃষ্টবশে কখনও সত্ত্বগুণ অপর দুইটিকে অভিভূত করিয়া প্রবল হয় এবং জীবকে সুখাদিতে আসক্ত করে। এইরূপ কোথাও রজোগুণ প্রবল হইয়া কর্ম্মাসক্তি জন্মায় বা তমোগুণ প্রবল হইয়া নিদ্রা, প্রমাদ, আলস্যাদি উৎপন্ন করে। এই হেতুই বিভিন্ন জীবের সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক এইরূপ বিভিন্ন প্রকৃতি দৃষ্ট হয়।

এই কয়েকটি শ্লোকে (১০ম-১৩শ) সাত্ত্বিক, রাজস ও তামস এই ত্রিবিধ স্বভাবের লক্ষণ বলা হইতেছে।

সর্ব্বদ্বারেষু দেহেহস্মিন্ প্রকাশ উপজায়তে।
জ্ঞানং যদা তদা বিদ্যাদ্ বিবৃদ্ধিং সত্ত্বমিত্যুত।।১১

অর্থঃ-(১১) যখনই এই দেহে শ্রোত্রাদি সর্ব্ব ইন্দ্রিয়দ্বারে জ্ঞানাত্মক প্রকাশ অর্থাৎ নির্ম্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তখন জানিবে যে সত্ত্বগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়াছে।

এস্থলে 'উত' শব্দদ্বারা সুখাদি লক্ষণও বুঝিতে হইবে।

লোভঃ প্রবৃত্তিরারন্মঃ কর্ম্মণামশমঃ স্পৃহা।
রজস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে ভরতর্ষভ।।১২

তাশমঃ অশান্তিঃ, অতৃপ্তি; সর্ব্বদা ইহা করিয়া উহা করিব ইত্যাদি রূপ অস্থিরতা।

অর্থঃ-(১২) হে ভরতশ্রেষ্ঠ, লোভ, সর্ব্বদা কর্ম্মে প্রবৃত্তি এবং সর্ব্ব কর্ম্মে উদ্যম, শান্তি ও তৃপ্তির অভাব, বিষয়স্পৃহা এই সকল লক্ষণ রজোগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে উৎপন্ন হয়।

অপ্রকাশোহপ্রবৃত্তিশ্চ প্রমাদো মোহ এব চ।
তমস্যেতানি জায়ন্তে বিবৃদ্ধে কুরুনন্দন।।১৩

অর্থঃ-(১৩) হে কুরুনন্দন, তমোগুণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইলে বিবেক-ভ্রংশ, নিরুদ্যমতা, কর্ত্তব্যের বিস্মরণ এবং মোহ বা বুদ্দি-বিপর্য্যয় এই সকল লক্ষণ উৎপন্ন হয়।

যদা সত্ত্বে প্রবৃদ্ধে তু প্রলয়ং যাতি দেহভূৎ।
তদোত্তমবিদাং লোকানমলান্ প্রতিপদ্যতে।।১৪

অর্থঃ-(১৪) সত্ত্বগুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হইলে যদি জীবের মৃত্যু হয়, তবে তিনি তত্ত্ববিদ্‌গণের প্রাপ্য প্রকাশময় দিব্য লোকসকল প্রাপ্ত হন।

উত্তমবিদাং উত্তমবিদ্‌গণের অর্থাৎ মহদাদি-তত্ত্ববিদ্‌গণের (শঙ্কর); হিরণ্যগর্ভাদির উপাসকগণের (শ্রীধর); উত্তম তত্ত্ব-জ্ঞানীদিগের অর্থাৎ দেবতা প্রভৃতির (তিলক)।

রজসি প্রলয়ং গত্বা কর্ম্মসঙ্গিষু জায়তে।
তথা প্রলীনস্তমসি মূঢ়যোনিষু জায়তে।।১৫

অর্থঃ-(১৫) রজোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে কর্ম্মাসক্ত মনুষ্য-যোনিতে জন্ম হয় এবং তমোগুণের বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে পশ্বাদি মূঢ় যোনিতে জন্ম হয়।

কর্ম্মণঃ সুকৃতস্যাহুঃ সাত্ত্বিকং নির্ম্মলং ফলম্।
রজসস্তু ফলং দুঃখমজ্ঞানং তমসঃ ফলম্।।১৬

অর্থঃ-(১৬) সাত্ত্বিক পুণ্য কর্ম্মের ফল নির্ম্মল সুখ, রাজসিক কর্ম্মের ফল দুঃখ এবং তামসিক কর্ম্মের ফল অজ্ঞান, এইরূপ তত্ত্বদর্শিগণ বলিয়া থাকেন।

সত্ত্বাৎ সংজায়তে জ্ঞানং রজসো লোভ এবচ।
প্রমাদমোহৌ তমসো ভবতোহজ্ঞানমেব চ।।১৭

অর্থঃ-(১৭) সত্ত্বগুণ হইতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়; এবং রজোগুণ হইতে লোভ এবং তমোগুণ হইতে অজ্ঞান, প্রমাদ ও মোহ উৎপন্ন হইয়া থাকে।

ঊর্দ্ধং গচ্ছন্তি সত্ত্বস্থা মধ্যে তিষ্ঠন্তি রাজসাঃ।
জঘন্যগুণবৃত্তিস্থা অধো গচ্ছন্তি তামসাঃ।।১৮

জঘন্যগুণবৃত্তিস্থাঃ জঘন্যো নিকৃষ্টঃ তমোগুণঃ তস্য বৃত্তঃ প্রমাদমোহাদিঃ তত্র স্থিতাঃ (শ্রীধর)।

অর্থঃ-(১৮) সত্ত্বগুণপ্রধান ব্যক্তি ঊর্দ্ধলোকে অর্থাৎ স্বর্গাদি লোকে গমন করেন; রজঃ প্রধান ব্যক্তিগণ মধ্যলোকে অর্থাৎ ভূলোকে অবস্থান করেন; এবং প্রমাদ মোহাদি নিকৃষ্টগুণ-সম্পন্ন তমঃপ্রধান ব্যক্তিগণ অধোগামী হয় (তামিস্রাদি নরক বা পশ্বাদি যোনি প্রাপ্ত হয়)।

নান্যং গুণেভ্যঃ কর্ত্তারং যদা দ্রষ্টানুপশ্যতি।
গুণেভ্যশ্চ পরং বেত্তি মদ্ভাবং সোহধিগচ্ছতি।।১৯

অর্থঃ-(১৯) যখন দ্রষ্টা জীব, গুণ ভিন্ন অন্য কাহাকেও কর্তা না দেখেন (অর্থাৎ প্রকৃতিই কর্ম করে, আমি করি না, ইহা বুঝিতে পারেন) এবং ত্রিগুণের অতীত পরম বস্তুকে অর্থাৎ আত্মাকে জ্ঞাত হন, তখন আমার ভাব অর্থাৎ ব্রহ্মভাব বা ত্রিগুণাতীত অবস্থা প্রাপ্ত হন।

গুণানেতানতীত্য ত্রীন্ দেহী দেহসমুদ্ভবান্।
জন্মমৃত্যুজরাদুঃখৈর্বিমুক্তোহমৃতমশ্নুতে।।২০

দেহ-সমুদ্ভবান্‌ - দেহঃ সমুদ্ভবঃ পরিণামো যেষাং তান্‌ দেহোৎপত্তিবীজভূতানিত্যর্থঃ (শ্রীধর)।

অর্থঃ-(২০) জীব দেহোৎপত্তির কারণভূত এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া জন্মমৃত্যুজরাদুঃখ হইতে বিমুক্ত হইয়া অমৃতত্ব অর্থাৎ মোক্ষ লাভ করেন।

প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই জীবের দেহোৎপত্তি ও সংসারিত্ব। এই ত্রিগুণ অতিক্রম করিতে পারিলেই মোক্ষ। তাহার উপায় কি? সাংখ্য দর্শন বলেন যে, জীব যখন বুঝিতে পারে যে প্রকৃত পৃথক, আমি পৃথক, তখনই তাহার মুক্তি হয়। কিন্তু বেদান্ত ও গীতা সাংখ্যের এই প্রকৃতি-পুরুষরূপী দ্বৈতকে মূল তত্ত্ব বলিয়া স্বীকার করেন না। সুতরাং এই কথাটিই গীতায় এইরূপ ভাবে বলা হয় যে, প্রকৃতি ও পুরুষের উপরে যে পরমাত্মা বা পুরুষোত্তম আছেন, সেই পরমাত্মাকে যখন জীব জানিতে পারে তখনই তাহার মোক্ষ বা ব্রহ্মভাব লাভ হয়।

অর্জ্জুন উবাচ

কৈর্লিঙ্গৈর্স্ত্রিন্ গুণানেতানতীতো ভবতি প্রভো।
কিমাচারঃ কথং চৈতাংস্ত্রীন্ গুণানতিবর্ত্ততে।।২১

অর্থঃ-(২১) অর্জুন কহিলেন, - হে প্রভো, কোন্‌ লক্ষণের দ্বারা জানা যায় যে জীব ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়াছেন? তাহার আচার কিরূপ? এবং কি প্রকারে তিনি ত্রিগুণ অতিক্রম করেন।

পূর্ব্ব শ্লোকে বলা হইয়াছে যে ত্রিগুণাতীত হইলেই মোক্ষ লাভ হয়। এক্ষণে অর্জ্জুন জানিতে চাহিতেছেন যে, ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ কি এবং ত্রিগুণাতীত হওয়ার উপায় কি? দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞ সন্বন্ধেও এইরূপ প্রশ্ন করিয়াছিলেন (২।৫৪) এই স্থিতপ্রজ্ঞ এবং ত্রিগুণাতীতের অবস্থা একই। ইহাকেই ব্রহ্মীস্থিতি বলে।

শ্রীভগবানুবাচ

প্রকাশঞ্চ প্রবৃত্তিঞ্চ মোহমেব চ পাণ্ডব।
ন দ্বেষ্টি সংপ্রবৃত্তানি ন নিবৃত্তানি কাঙ্ক্ষতি।।২২

অর্থঃ-(২২) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন, - হে পাণ্ডব, সত্ত্বগুণের কার্য্য প্রকাশ বা জ্ঞান, রজোগুণের ধর্ম্ম-কর্ম্ম-প্রবৃত্তি এবং তমোগুণের ধর্ম্ম মোহ, এই সকল গুণধর্ম্ম প্রবৃদ্ধি হইলেও যিনি দুঃখবুদ্ধিতে দ্বেষ করেন না এবং ঐ সকল কার্য্য নিবৃত্ত থাকিলে যিনি সুখবুদ্ধিতে উহা আকাঙ্খা করেন না, তিনিই গুণাতীত বলিয়া উক্ত হন।

তাৎপর্য এই যে, দেহে প্রকৃতির কার্য্য চলিচেছে চলুক। আমি উহাতে লিপ্ত নই। আমি অকর্ত্তা, উদাসীন, সাক্ষিস্বরূপ। এই জ্ঞান যাঁহার হইয়াছে তিনিই ত্রিগুণাতীত। দেহ থাকিতে ত্রিগুণের কার্য্য চলিবেই, কিন্তু দেহী যখন ইহাতে লিপ্ত হন না, তখনই তিনি ত্রিগুণাতীত হন।

উদাসীনবদাসীনো গুণৈর্যো ন বিচাল্যতে।
গুণা বর্ত্তন্ত ইত্যেব যোহবতিষ্ঠতি নেঙ্গতে।।২৩

অর্থঃ-(২৩) যিনি উদাসীনের ন্যায় সাক্ষীস্বরূপ অবস্থান করেন, সত্ত্বাদিগুণকার্য্য সুখ-দুঃখাদি কর্ত্তৃক বিচলিত হন না, গুণ সকল স্ব স্ব কার্য্যে বর্ত্তমান আছে, আমার সহিত ইহার কোন সম্পর্ক নাই, ইহা মনে করিয়া যিনি চঞ্চল হন না, তিনি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন।

সমদুঃখসুখঃ স্বস্থঃ সমলোষ্টাশ্মকাঞ্চনঃ।
তুল্যপ্রিয়াপ্রিয়ো ধীরস্তুল্যনিন্দাত্মসংস্তুতিঃ।।২৪

অর্থঃ-(২৪) যাহার নিকট সুখদুঃখ সমান, যিনি স্ব-স্ব অর্থাৎ আত্মস্বরূপেই স্থিত, মৃত্তকা, প্রস্তর ও সুবর্ণ যাহার নিকট সমান, যিনি প্রিয় ও অপ্রিয় এবং আপনার নিন্দা ও প্রশংসা তুল্য মনে করেন, যিনি ধীমান্‌ বা ধৈর্য্যযুক্ত, তিনিই গুণাতীত বলিয়া অভিহিত হন।

মানাপমানয়োস্তুল্যস্তুল্যো মিত্রারিপক্ষয়োঃ।
সর্ব্বারম্ভপরিত্যাগী গুণাতীতঃ স উচ্যতে।।২৫

অর্থঃ-(২৫) মান ও অপমানে, শত্রুপক্ষ ও মিত্রপক্ষে যাঁহার তুল্য জ্ঞান এবং ফলাকাঙ্ক্ষা করিয়া যিনি কোন কর্ম্মোদ্যম করেন আন, এরূপ ব্যক্তি গুণাতীত বলিয়া কথিত হন।

ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ ২১শ-২৫শ শ্লোকে ত্রিগুণাতীত পুরুষের লক্ষণ বর্ণিত হইয়াছে। দেহে গুণের কার্য্য চলিতে থাকিল যিনি উদাসীনের ন্যায় স্বাক্ষিস্বরূপে অবস্থিত থাকেন, গুণকার্য সুখদুঃখ মোহাদি কর্ত্তৃক বিচলিত হন না, তিনিই ত্রিগুণাতীত; তিনি নির্দ্বন্দ্ব, নিঃসঙ্গ, সর্ব্বত্র সমবুদ্ধিসম্পন্ন। সাংখ্যের পরিভাষায় যাহা ত্রিগুণাত্মিকা প্রকৃত, বেদান্তের ভাষায় তাহাই অজ্ঞান বা মায়া। সুতরাং ত্রিগুণাতীত অবস্থাই হইতেছে মায়ামুক্ত হইয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হওয়া, ইহাই ব্রাহ্মীস্থিতি (২।৭২)। এস্থলে দ্রষ্টব্য এই যে, দ্বিতীয় অধ্যায়ের স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা (২।৫৫-৭২), দ্বাদশ অধ্যায়ের ভক্তের লক্ষণ (১২।১৩-২০) এবং ৩।৪র্থ প্রভৃতি অধ্যায়ে বর্ণিত কর্ম্মযোগীর লক্ষণ (৩।২৫।২৮।৩০, ৪।১৮-২৩, ৫।৭, ১৮।২৬), এসকলই মূলতঃ এক, বর্ণনাও অনেক স্থলেই শব্দশঃ একরূপ। একরূপ। স্থূল কথা এই, জ্ঞান, কর্ম্ম, যোগ, ভক্তি যিনি যে পথই অবলম্বন করুন না কেন, শেষে সিদ্ধাবস্থার লক্ষণ একরূপই দাঁড়ায়। গীতার বিশেষত্ব এই যে, গীতা জ্ঞানোত্তর কর্ম্মের নিষেধ করেন নাই, বরং লোকসংগ্রহার্থ কর্মের উপদেশ দিয়াছেন, এবং জ্ঞান-কর্মের সঙ্গেই ভক্তি সংযুক্ত করিয়া দিয়াছেন। গীতামতে ভক্তিদ্বারাই ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ হয় (পরের শ্লোক)।

মাঞ্চ যোহব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে।
স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্রহ্মভূয়ায় কল্পতে।।২৬

অর্থঃ-(২৬) যিনি ঐকান্তিক অভিযোগ সহকারে আমার সেবা করেন, তিনি এই তিন গুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব লাভে সমর্থ হন।

ব্রহ্মণো হি প্রতিষ্ঠাহমমৃতস্যাব্যয়স্য চ।
শাশ্বতস্য চ ধর্ম্মস্য সুখস্যৈকান্তিকস্যচ।।২৭

প্রতিষ্ঠা প্রতিমা; ঘনীভূত ব্রহ্মৈবাহংযিথা ঘনীভূতঃ প্রকাশ এর সূর্য্যমণ্ডলং তত্ত্বদ্‌ ইত্যর্থঃ (শ্রীধর)। - আমি বাসুদেব ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা অর্থাৎ ঘনীভূত ব্রহ্ম, যেমন, সূর্য্যমণদল ঘনীভূত প্রকাশস্বরূপ, তদ্রূপ।

অর্থঃ-(২৭) যেহেতু আমি ব্রহ্মের, নিত্য অমৃতের অর্থাৎ মোক্ষের, সনাতন ধর্ম্মের এবং ঐকান্তি সুখের প্রতিষ্ঠা, (অথবা আমি অমৃত ও অব্যয় ব্রহ্মের, শাশ্বত ধর্ম্মের এবং ঐকান্তিক সুখের প্রতিষ্ঠা।

আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা ভগবত্তত্ত্ব ও ব্রহ্মতত্ত্বঃ

সাংখ্যমতে ত্রিগুণাতীত হইয়া 'কেবল হওয়া' বা কৈবল্যলাভের একমাত্র উপায় পঞ্চবিংশতি তত্ত্বের জ্ঞান। পাতঞ্জলমতে ধ্যান-ধারণা ও পরিশেষে নির্ব্বীজ সমাধি; সাংখ্যে যাহাকে প্রকৃতি বলে, অদ্বৈত বেদান্তে তাহাই অজ্ঞান বা মায়া; বেদান্ত মতে, তত্ত্বমস্যাদি মহাবাক্যের শ্রবণ-মনন-নিদিধ্যাসন দ্বারা এই অজ্ঞান বা মায়া কাটিয়া অপরোক্ষ আত্মনুভূতি বা ব্রহ্মভাব লাভ হয়। এস্থলে কিন্তু শ্রীভগবান্‌ বলিতেছেন, 'আমাকে একান্ত ভক্তিযোগে সেবা করিলেই ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভ করা যায়; কারণ, আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা'; ৭।২৯ শ্লোকেও এইরূপ কথাই আছে। আবার অন্যত্র আছে, 'ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হইলে আমাতে পরা ভক্তি জন্মে' (১৮।৫৪)। এই 'আমি'কে, ব্রহ্ম কোন্‌ বস্তু, আর ব্রহ্মভাবই বা কি? 'আমি' বলিতে অবশ্য এস্থলে বুঝায় স্বয়ং ভগবান্‌ শ্রীকৃষ্ণ। কিন্তু ভগবানে ও ব্রহ্মে কি কোন পার্থক্য আছে? আছেও; নাইও। স্বরূপতঃ না থাকিলেও সাধকের নিকট যে পার্থক্য আছে তাহা বুঝা যায় দ্বাদশ অধ্যায়ে অর্জ্জুনের প্রশ্নে। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন - 'তোমাকে যাঁহারা ত্বদ্‌গতচিত্ত হইয়া ভজনা করেন, আর যাঁহারা অক্ষর ব্রহ্ম চিন্তা করেন, এ উভয়ের মধ্যে শ্রেষ্ঠ সাধক কে?' তদুত্তরে শ্রীভগবান্‌ বলিলেন - 'আমার ভক্তই শ্রেষ্ঠ সাধক, তবে অক্ষর ব্রহ্মচিন্তকেরাও আমাকেই পান'। এ কথার মর্ম্ম এই যে, অক্ষর ব্রহ্ম আমিই, ব্রহ্মভাব আমারই বিভাব, নির্গুণভাবে আমি অক্ষর ব্রহ্ম, সগুণভাবে আমি বিশ্বরূপ, লীলাভাবে আমি অবতার আমি পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব - 'মত্তঃ পরতং নান্যং কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় (৭।৭)', - ব্রহ্ম, আত্মা, বিরাট্‌, বৈশ্বানর, তৈজস, প্রাজ্ঞ, তুরীয়, সকলই আমি, সকল অবস্থাই আমার বিভাব বা বিভিন্ন ভাব। এই সগুণ-নির্গুণ, সৃষ্টিস্থিতি-প্রলয়কর্ত্তা, যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্ব্বলোকমহেশ্বর পরমাত্মা পুরুষোত্তমই ভগবৎ-তত্ত্ব; আর উহার যে অনির্দ্দেশ্য, অক্ষর নির্ব্বিশেষ, নির্গুণ বিভাব, তাহাই ব্রহ্মতত্ত্ব। এই অর্থে বলা হইয়াছে আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা, শাশ্বত ধর্মের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি।

কিন্তু মায়াবাদী বেদান্তী বলেন নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মই পরতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব, মায়ার বিজ্‌ম্ভণ, উপাধি-কল্পিত অবস্তু ঈশ্বরত্বন্তু জীবত্বং উপাধিদ্বয় কল্পিতং (পঞ্চদশী); পক্ষান্তরে ভাগবত-শাস্ত্রী বলেন, স্বয়ং ভগবানই পরতত্ত্ব, ব্রহ্ম তাহার অঙ্গজ্যোতিঃ - যদদ্বৈতং ব্রহ্মোপনিষদি তদপাস্য তনুভা (চরিতামৃত)।

বৈষ্ণব গোস্বামীপাদের এই উক্তিকে লক্ষ্য করিয়া বেদান্তী বলেন ওকথায় বেদ অমান্য করা হয়, কোন ঋষিপ্রণীত শাস্ত্রে এমন কথা নাই। কিন্তু কথাটার রূপকের ভাষা ত্যাগ করিলে উহা 'আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা' গীতোক্ত এই ভগবাদ্বোক্যের অনুবাদ বলিয়াই বোধ হয়; গীতা অবশ্য ঋষি-প্রণীত শাস্ত্র। বস্তুতঃ গীতা ভাগবত-ধর্ম্মের গ্রন্থ, ব্রহ্মতত্ত্ব ও ভগবত্তত্ত্ব ইহাতে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বাসুদেব-ভক্তিই ইহার প্রধান কথা; ভগবান্‌ বাসুদেবই পরব্রহ্ম সগুণও তিনি নির্গুণও তিনি, তিনিই সমস্ত তাঁহা ভিন্ন আর কিছু নাই - 'সর্বং ত্বমেব সগুণ্যে বিগুণশ্চ ভূমন্‌ নানৃৎ ত্বদন্ত্যপি মনোবচসা নিরুত্তম্‌' (ভাগবত ৭।৯।৪৮)। প্রশ্ন হইতে পারে, - তিনিই যখন পরব্রহ্ম, তখন 'আমি ব্রহ্ম বলিলেই হয়, 'আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা', - একথারই বা কি প্রয়োজন? এস্থলে প্রয়োজন আছে। ত্রিগুণাতীত কথাটা সাংখ্যদর্শনের, উহা নিরীশ্বর। সাংখ্যমতে একমাত্র জ্ঞানই কৈবল্য-লাভের উপায় ('জ্ঞানান্মুক্তিঃ'-সাংখ্যসূত্র ৩।২০)। বেদান্ত মতেও জ্ঞানই ব্রহ্মভাব বা মোক্ষলাভের উপায়, ব্রহ্মসূত্রে কোথায়ও ভক্তি শব্দ নাই। কিন্তু এস্থলে ভগবান্‌ বলিতেছেন ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব লাভের উপায় আমাতে (অর্থাৎ ভগবান্‌ বাসুদেবে) অব্যভিচারিণী ভক্তি। কাজেই তাঁহাকে বুঝাইতে হইল যে ব্রহ্মভাব আমারই অর্থাৎ ভগবান্‌ পুরুষোত্তমেরই বিভাব অর্থাৎ ভগবৎ-তত্ত্বেই প্রতিষ্ঠিত, সুতরাং ভগবান্‌ ভক্তিদ্বারাই অধিগম্য। সাধনপথে ভক্তির উপযোগিতা স্বীকার করিলেই ভগবত্তত্ত্বের শ্রেষ্ঠতা স্বতঃই আসিবে, এই হেতু গীতা-বেদান্তাদি শাস্ত্রের মূলতত্ত্ব স্বীকার করিলেও উহাতে ঈশ্বর-বাদেরই প্রাধান্য।

গীতা সাধারণভাবে সেই সেই দর্শনের (সাংখ্য, বেদান্তাদির) মূল প্রতিপাদ্য অস্বীকার করিয়া তাহার সহিত ঈশ্বরবাদ সংযুক্ত করিয়া তাহাদিগকে সুসম্পূর্ণ করিয়াছেন। এই ঈশ্বরবাদই গীতার প্রাণ; গীতার আদি, অন্ত, মধ্য সমস্তই ঈশ্বরবাদে সমুজ্জল। - বেদান্তরত্ন হীরেন্দ্রনাথ, গীতার ঈশ্বরবাদ।

কিন্তু যাঁহারা ঈশ্বরতত্ত্বকে গৌণ করিয়া ব্রহ্মতত্ত্বই পরতত্ত্ব বলিয়া গ্রহণ করেন, তাঁহাদের পক্ষে 'আমিই ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা' এই কথার সরল অর্থ গ্রহণ করা চলে না। কাজেই তাঁহারা এই বাক্যের শব্দার্থ লইয়া অনেক 'টানাবুনা' করিয়াছেন। কেহ বলেন, এ স্থলে 'আমি' বলিতে বুঝায় 'নিরুপাধিক ব্রহ্ম' এবং 'ব্রহ্ম' বলিতে বুঝায় 'সোপাধিক ব্রহ্ম' কেহ বলেন, এস্থলে ব্রহ্ম অর্থ প্রকৃতি, 'আমি' পরব্রহ্ম; কেহ বলেন, এস্থলে 'ব্রহ্ম' অর্থ বেদ ইত্যাদি; এরকম পূর্ব্বাপর সঙ্গতি ও সামঞ্জস্য রক্ষা হয় না। উহা 'গরজমূলক, সরল নহে'।

আবার এই মতাবলমসী কেহ কেহ পূর্ব্বোক্ত সরল অর্থই গ্রহণ করেন, কিন্তু বলেন যে সম্ভবতঃ এই শ্লোকটি প্রক্ষিপ্ত। 'প্রক্ষেপের' কারণস্বরূপ বলেন

"পূর্ব্ব শ্লোকে বলা হইতেছে যে কৃষ্ণকে ভক্তি করিলে ব্রহ্মভাব লাভ করা যায়। ইহাতে ব্রহ্মেরই শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপন্ন হয়। ব্রহ্মত্ব প্রাপ্তিই লক্ষ্য। ইহার উপায় কৃষ্ণভক্তি। যাহা লক্ষ্য তাহাই শ্রেষ্ঠতর; লক্ষ্য অপেক্ষা পথ শ্রেষ্ঠ হয় না। কিন্তু কৃষ্ণভক্তি অপেক্ষা পরব্রহ্ম প্রাপ্তি শ্রেষ্ঠ হইবে, বৈষ্ণব পণ্ডিতগণ এভাব পছন্দ করেন নাই। ব্রহ্মকে হীন করিয়া কৃষ্ণকে শ্রেষ্ঠ করা আবশ্যক হইয়াছিল। এই জন্য কোন বৈষ্ণব পণ্ডিত 'ব্রহ্মণ্যেহিপ্রতিষ্ঠাহং," ইত্যাদি অংশ সংযোজন করিয়াছেন স্বর্গত মহেশচন্দ্র ঘোষ, প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩৩৫।

এ সন্বন্ধে বিবেচ্য এই যে শ্রীমৎ শঙ্করাচার্য্য এই শ্লোক গ্রহণ করিয়াছেন, সুতরাং প্রক্ষেপ হইলে তাঁর পূর্ব্ববর্ত্তী কালে হইয়াছে। সেই প্রাচীনকালে কোন বৈষ্ণব পণ্ডিত উক্তরূপ উদ্দেশ্য লইয়া বৈষ্ণবগণের নমস্য শ্রীগীতার মধ্যে কোন অংশ প্রক্ষিপ্ত করা আবশ্যক বোধ করিয়াছেন, এরূপ সিদ্ধান্ত বিশেষ প্রমাণ-সাপেক্ষ। সে যাহা হইক, পূর্ব্বোক্তরূপ যুক্তি অবলম্বন করিলে শ্রীগীতার অন্যান্য স্থলের আলোচনায় ইহার ঠিক বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হইতে হয়, এস্থলে যেমন বলা হইয়াছে, আমাতে ভক্তি করিলে ব্রহ্মভাব লাভ হয় (১৪।২৬), আবার ৮।৫৪-৫৫ শ্লোকে বলা হইয়াছে যে, 'ব্রহ্মভাব লাভ হইলে আমাতে পরা-ভক্তি জন্মে এবং ভক্তিদ্বারাই আমাকে তত্ত্বতঃ জানিয়া আমাতে প্রবেশ করা যায়'। পূর্ব্বোক্ত যুক্তি-বলেই বলা যায় যে, এস্থলে ব্রহ্মভাব হইতে কৃষ্ণভক্তিকেই শ্রেষ্ঠ বলা হইয়াছে এবং ব্রহ্মতত্ত্বের উপরে ভগবত্তত্ত্বকে স্থাপন করা হইয়াছে। বস্তুতঃ কৃষ্ণ বড় কি ব্রহ্ম বড়, এরূপ ধারণা সাম্প্রদায়িক সংস্কারবশতঃ উপস্থিত হয়। উভয়েই তত্ত্বতঃ একই বস্তু, ব্রহ্মতত্ত্ব ও ভগবত্তত্ত্ব একই বস্তুর বিভিন্ন বিভাব। পূর্ব্বোক্ত উভয় স্থলের সংযোগে এইরূপ অর্থই স্পষ্ট প্রতীত হয় যে, পরম জ্ঞান ও পরা ভক্তি একই অবস্থা এবং যে পরম পুরুষকে ভক্তি করা যায় এবং যাঁহাতে প্রবেশ করা যায়, ব্রহ্মভাব তাহারই একটি বিভাব, সুতরাং তাঁহার অন্তর্ভূক্তি।

চতুর্দ্দশ অধ্যায় বিশ্লেষণ ও সার-সংক্ষেপ
গুণত্রয়-বিভাগযোগ

ত্রয়োদশ অধ্যায়ে পুরুষ-প্রকৃতি বিচারে বলা হইয়াছে যে পুরুষ অকর্ত্তা, নিঃসঙ্গ; প্রকৃতির গুণসঙ্গবশতঃই পুরুষের সদসৎ যোনিতে জন্ম বা সংসারিত্ব। এই ত্রিগুণের লক্ষণ কি, কি ভাবে উহারা জীবকে আবদ্ধ করে, কিরূপে ত্রিগুণাতীত হইয়া মুক্ত হওয়া যায়, ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ কি এই সকল বিষয় বিস্তারিত বলা হয় নাই। আবার, দ্বিতীয় অধ্যায়ে কর্ম্মযোগের উপদেশ-প্রসঙ্গে শ্রীভগবান্‌ অর্জ্জুনকে বলিয়াছেন, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও, নিত্যসত্ত্বস্থ হও। এ সকল কথার প্রকৃত তাৎপর্য পূর্ব্বে বলা হয় নাই। এই হেতুই এই অধ্যায়ের এই ত্রিগুণতত্ত্ব পুনরায় বিস্তারিতভাবে বলিতেছেন।

সৃষ্টি-রহস্যঃ এই চরাচর জগৎ প্রকৃতিরই পরিণাম, কিন্তু প্রকৃতির স্বয়ং সৃষ্টির সামর্থ্য নাই, পরমেশ্বরের সৃষ্টি-সঙ্কল্পই প্রকৃতিতে গর্ভাধানস্বরূপ; উহা হইতে ভূতসৃষ্টি। পরমেশ্বর ভূতগণের পিতৃস্বরূপ এবং প্রকৃতি মাতৃ-স্বরূপিণী। (কিন্তু নিরীশ্বর সাংখ্যমতে প্রকৃতি প্রসবধর্মী অর্থাৎ স্বয়ংই সৃষ্টিসমর্থা; গীতার উহা মান্য নহে।)

পুরুষের সংসার বন্ধন সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ, - প্রকৃতির এই তিন গুণ। এই গুণসঙ্গবশতঃ পুরুষের সংসারবন্ধন। মিশ্র সত্ত্বগুণের মুখ্য ধর্ম্ম সুখ ও জ্ঞান। উহার ফলে জীব বিষয়-সুখ ও বৈষয়িক জ্ঞানে আবদ্ধ হইয়া 'আমি জ্ঞানী' ইত্যাদি রূপ অভিমান করতঃ বিষয়ে আবদ্ধ হয়। রজোগুণের ধর্ম্ম রাগাত্মক, উহার ফল তৃষ্ণা ও আসক্তি উহাতে জীব বিবিধ কর্ম্মে আসক্ত হইয়া দুঃখভোগ করে। তমোগুণের ধর্ম্ম মোহ, অজ্ঞান উহা প্রমাদ, আলস্য, নিদ্রাদি দ্বারা জীবকে আবদ্ধ করে। এই তিন গুণ পৃথক্‌ পৃথক্‌ থাকে না, অপর দুইটিকে অভিভূত করিয়া কোন একটি প্রবল হয় (গুণত্রয়ের বৈষম্যই সৃষ্টি। গুণত্রয়ের সাম্যাবস্থাই অব্যক্তাবস্থা বা প্রলয়)।

সাত্ত্বিকাদি ত্রিবিধ স্বভাবের লক্ষণ সত্ত্বগুণ প্রবল হইলে সর্ব্ব ইন্দ্রিয়-দ্বারে প্রকাশ বা নির্ম্মল জ্ঞান উৎপন্ন হয়। রজোগুণ প্রবল হইলে প্রবল বিষয়স্পৃহা, কর্ম্ম-প্রবৃত্তি, অস্থিরতা ইত্যাদি উৎপন্ন হয়। তমোগুণ প্রবল হইলে অনুদ্যম, কর্ত্তব্যের বিস্মৃত, বুদ্ধি-বিপর্য্যয় প্রভৃতি লক্ষণ উপস্থিত হয়। সাত্ত্বিক কর্ম্মের ফল সুখ, রাজসিক কর্ম্মের ফল দুঃখ, তামসিক কর্ম্মের ফল অজ্ঞান।

সত্ত্বগুণবৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে স্বর্গাদি দিব্যলোক প্রাপ্তি হয়, রজোগুণ বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে মনুষ্যযোনিতে জন্ম হয় এবং তমোগুণ বৃদ্ধিকালে মৃত্যু হইলে পশ্বাদি মূঢ়-যোনিতে জন্ম হয়। সাত্ত্বিক গুণের প্রাবল্যে স্বর্গাদিলাভ হয় বটে, কিন্তু ত্রিগুণাতীত না হইলে মোক্ষলাভ হয় না।

ত্রিগুণাতীতের লক্ষণ ত্রিগুণাতীত হইবার উপায়

দেহে গুণের কার্য্য চলিতে থাকিলেও যিনি উদাসীনের ন্যায় সাক্ষিস্বরূপে অবস্থিতি করেন, সত্ত্বাদি-গুণধর্ম্ম সুখদুঃখাদি কর্ত্তৃক বিচালিত হন না, তিনিই ত্রিগুণাতীত; যাঁহার সর্ব্ববিষয়ে সমত্ববুদ্ধি, যাঁহার নিকট সুখদুঃখ, মান-অপমান, স্তুতি-নিন্দা, শত্রু-মিত্র সকলই সমান, তিনি ত্রিগুণাতীত।

যিনি একনিষ্ঠ ভক্তিযোগ সহকারে ভগবান্‌ পুরুষোত্তমের ভজনা করেন, তিনিই ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন। কারণ নির্গুণ ব্রহ্মভাব, শাশ্বত ধর্ম, ঐকান্তিক সুখ, এ সকলেরই একমাত্র আশ্রয় বা প্রতিষ্ঠা তিনিই।

এই অধ্যায়ে প্রধানতঃ ত্রিগুণতত্ত্বই বর্ণিত হইয়াছে, এই হেতু ইহাকে গুণত্রয়বিভাগযোগ বলে।

ইদি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে গুণত্রয়বিভাগযোগো নাম চতুর্দ্দশোহধ্যায়ঃ।