Popular Posts

Thursday, June 20, 2013

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : সপ্তমোহধ্যায় (শ্লোক অর্থসহ)



শ্রীভগবানুবাচ -

ময্যাসক্তমনাঃ পার্থ যোগং যুঞ্জন্ মদাশ্রয়ঃ
অসংশয়ং মাং যথা জ্ঞাস্যসি তচ্ছৃণু।।

অর্থঃ- (১) শ্রীভগবান্‌ বলিলেন - হে পার্থ, তুমি আমাতে আসক্তচিত্ত এবং একমাত্র আমার শরণাপন্ন হইয়া যোগযুক্ত হইলে যেরূপে আমার সর্ব্ববিভূতিসম্পন্ন সমগ্র স্বরূপ নিঃসংশয়ে জানিতে পারিবে তাহা শ্রবণ কর।

পূর্ব্ব আধ্যায়ের শেষে শ্রীভগবান্‌ বলিয়াছেন, যোগিগণের মধ্যে যিনি মদ্গতচিত্তে আমাকে ভজনা করেন, তিনিই যুক্ততম। কিন্তু এই আমি কে? তাঁহার সমগ্র স্বরূপ কি? কি ভাবে তাঁহাকে ভাবনা করিতে হয়, ভজন করিতে হয়, তাহা এ পর্য্যন্ত কিছুই বলেন নাই। এই অধ্যায় এবং পরবর্ত্তী অধ্যায়সমূহে সেই সকল গুঢ় রহস্য কথিত হইয়াছে।

জ্ঞানং তেহহং সবিজ্ঞানমিদং বক্ষ্যাম্যশেষতঃ
যজ্ জ্ঞাত্মা নেহ ভূয়হন্যজ্ জ্ঞাতব্যমবশিষ্যতে।।

অর্থঃ- (২) আমি তোমাকে বিজ্ঞানসহ মৎস্বরূপ-বিষয়ক জ্ঞান বিশেষরূপে বলিতেছি। উহা জানিলে শ্রেয়োমার্গে পুনরায় জানিবার আর কিছু অবশিষ্ট থাকিবে না।

মনুষ্যণাং সহস্রেষু কশ্চিদ্ যততি সিদ্ধয়ে
যততামপি সিদ্ধানাং কশ্চিন্মাং বেত্তি তত্ত্বতঃ।।

অর্থঃ- (৩) সহস্র সহস্র মনুষ্যের মধ্যে হয়ত একজন মদ্বিষয়ক জ্ঞান লাভের জন্য যত্ন করে। আবার, যাঁহারা যত্ন করিয়া সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন মনে করেন, তাঁহাদিগেরও সহস্রের মধ্যে হয়ত একজন আমার প্রকৃত স্বরূপ জানিতে পারেন। (অর্থাৎ যাঁহাদিগকে তত্ত্বজ্ঞানী বা আত্মজ্ঞানী বলে, তাঁহাদিগেরও সহস্র জনের মধ্যে হয়ত একজন আমার প্রকৃত স্বরূপ জানেন। উহা অতি গুহ্য বিষয়)।

ভূমিরাপোহনলো বায়ুঃ খংমনোবুদ্ধিরেবচ
অহংকার ইতীয়ং মে ভিন্না প্রকৃতিরষ্টধা।।

অর্থঃ- (৪) ক্ষিতি, অপ্‌ (জল), তেজ, মরুৎ (বায়ু), ব্যোম (আকাশ), মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার, এইরূপে আমার প্রকৃতি অষ্টভাগে ভেদ প্রাপ্ত হইয়াছে।

অপরেয়মিতস্ত্বন্যাং প্রকৃতিং বিদ্ধি মে পরাম্
জীবভূতাং মহাবাহো যয়েদং ধার্য্যতে জগৎ।।

অর্থঃ- (৫) এই পূর্ব্বোক্ত অষ্টবিধা প্রকৃতি আমার অপরা প্রকৃত। ইহা ভিন্ন জীবরূপ চেতনাত্মিকা আমার পরা প্রকৃত আছে জানিও; হে মহাবাহো, সেই পরা প্রকৃতদ্বারা জগৎ বিধৃত রহিয়াছে।

এতদ্ যোনীনি ভূতানি সর্বাণীত্যুপধারয়
অহং কৃৎস্নস্য জগতঃ প্রভবঃ প্রলয়স্তথা।।

অর্থঃ- (৬) সমস্ত ভূত এই দুই প্রকৃত হইতে জাত, ইহা জানিও। সুতরাং আমিই নিখিল জগতের উৎপত্তি ও লয়ের কারণ। (সুতরাং আমি প্রকৃতপক্ষে জগতের কারণ)।

অচেতনা অপরা প্রকৃতি দেহাদিরূপে (ক্ষেত্র) পরিণাম প্রাপ্ত হয়, চেতনা পরা প্রকৃতি বা জীবচৈতন্য (ক্ষেত্রজ্ঞ) ভোক্তৃরূপে দেহে প্রবেশ করিয়া দেহাদি ধারণ করিয়া রাখে। এই দুই প্রকৃতি আমারই প্রকৃতি, আমা হইতেই উপন্ন বা আমারই বিভাব, সুতরাং আমিই প্রকৃতপক্ষে জগতের কারণ।

মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়
ময়ি সর্ব্বমিদং প্রোতং সূত্রে মণিগণা ইব।।

অর্থঃ- (৭) হে ধনঞ্জয়, আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ পরমার্থ-তত্ত্ব অন্য কিছুই নাই; সূত্রে মণি-সমূহের ন্যায় সর্ব্বভূতের অধিষ্ঠানস্বরূপ আমাতে এই সমস্ত জগৎ রহিয়াছে।

রসোহহমপ্স কৌন্তেয় প্রভাহস্মি শশিসূর্য্যয়োঃ
প্রণবঃ সর্ব্ববেদেষু শব্দঃ খে পৌরুষং নৃষু।।

অর্থঃ- (৮) হে কৌন্তেয়, জলে আমি রস, শশিসূর্য্যে আমি প্রভা, সর্ব্ববেদে আমি ওঙ্কার, আকাশে আমি শব্দ, মনুষ্য মধ্যে আমি পৌরুষরূপে বিদ্যমান আছি।

সকল পদার্থেরই যাহা সার, যাহা প্রাণ, তাহাতেই আমি অধিষ্ঠান করি। আমা ব্যতীত জল রসহীন, শশিসূর্য্য প্রভাবহীন, আকাশ শব্দহীন, পুরুষ পৌরুষহীন হয়; অর্থাৎ আমার সত্তায়ই সকলের সত্তা।

পুণ্যো গন্ধঃ পৃথিব্যাং চ তেজশ্চাস্মি বিভাবসৌ
জীবনং সর্ব্বভূতেষু তপশ্চাস্মি তপস্বিষু।।

অর্থঃ- (৯) আমি পৃথিবীতে পবিত্র গন্ধ, অগ্নিতে তেজ, সর্ব্বভূতে জীবন এবং তপস্বীদগের তপঃস্বরূপ।

বীজং মাং সর্ব্বভূতানাং বিদ্ধি পার্থ সনাতনম্
বুদ্ধির্বুদ্ধিমতামস্মি তেজস্তেজস্বিনামহম্।।১০

অর্থঃ- (১০) হে পার্থ, আমাকে সর্ব্বভূতের সনাতন বীজ বলিয়া জানিও। আমি বুদ্ধিমান্‌দিগের বুদ্ধি এবং তেজস্বিগণের তেজঃস্বরূপ।

বলং বলবতামস্মি কামরাগবিবর্জ্জিতম্
ধর্মাবিরুদ্ধো ভূতেষু কামোহস্মি ভরতর্ষভ।।১১

অর্থঃ- (১১) হে ভরতর্ষভ, আমিই বলবান্‌দিগের কামরাগরহিত বল (অর্থাৎ স্বধর্মানুষ্ঠান সমর্থ সাত্ত্বিক বল) এবং প্রাণিগণের ধর্ম্মের অবিরোধী কাম (অর্থাৎ দেহ ধারণাদির উপযোগী শাস্ত্রানুমত বিষয়াভিলাষ)।

আমি বলবান্‌দগের বল, কিন্তু সে বল সাত্ত্বিক বল। তাহা বিষয়তৃষ্ণা রহিত। আবার আমিই প্রাণিগণের মধ্যে কামরূপে বিদ্যমান আছি। কিন্তু সেই কাম ধর্ম্মের অবিরোধী, অর্থাৎ শাস্ত্রানুমত গার্হস্থ্য-ধর্ম্মের অনুকূল দেহ-ধারণাদি বা স্ত্রীপুত্রাদিতে অভিলাষ।

যে চৈব সাত্ত্বিকা ভাবা রাজসাস্তামসাশ্চ যে
মত্ত এবেতি তান্ বিদ্ধি ন ত্বহং তেষু তে ময়ি।।১২

অর্থঃ- (১২) শমদমাদি সাত্ত্বিক ভাব, হর্ষদর্পলোভাদি রাজসিক ভাব, শোকমোহাদি তামসিক ভাব, এই সকলই আমা হইতে জাত। কিন্তু আমি সে সকলে অবস্থিত নহি (অর্থাৎ জীবের ন্যায় সেই সকলের অধীন নহি), কিন্তু সে সকল আমাতে আছে (অর্থাৎ তাহারা আমার অধীন)।

ত্রিভির্গুণময়ৈর্ভাবৈরেভিঃ সর্ব্বমিদং জগৎ
মোহিতং নাভিজানাতি মামেভ্যঃ পরমব্যয়ম্।।১৩

অর্থঃ- (১৩) এই ত্রিবিধ গুণময় ভাবের দ্বারা (সত্ত্বরজস্তমোগুণ দ্বারা) সমস্ত জগৎ মোহিত হইয়া রহিয়াছে, এ-সকলের অতীত অক্ষয় আনন্দস্বরূপ আমাকে স্বরূপতঃ জানিতে পারে না।

দৈবী হ্যেষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া
মামেব যে প্রপদ্যন্তে মায়ামেতাং তরন্তি তে।।১৪

অর্থঃ- (১৪) এই ত্রিগুণাত্মিকা অলৌকিকী আমার মায়া নিতান্ত দুস্তরা। যাহারা একমাত্র আমারই শরণাগত হইয়া ভজনা করেন, তাহারাই কেবল এই সুদুস্তরা মায়া ঊত্তীর্ণ হইতে পারেন।

নং মাং দুস্কৃতিনো মূঢ়াঃ প্রপদ্যন্তে নরাধমাঃ
মায়য়াহপহৃজ্ঞানা আসুরং ভাবমাশ্রিতাঃ।।১৫

অর্থঃ- (১৫) পাপকর্ম্মপরায়ণ, বিবেকশূন্য নরাধমগণ মায়াদ্বারা হতজ্ঞান হইয়া আসুর স্বভাব প্রাপ্ত হওয়ায় আমাকে ভজনা করে না।

চতুর্ব্বিধা ভজন্তে মাং জনাঃ সুকৃতিনোহর্জ্জুন
আর্ত্তো জিজ্ঞাসুরর্থার্থী জ্ঞানী চ ভরতর্ষভ।।১৬

অর্থঃ- (১৬) হে ভরতর্ষভ, হে অর্জ্জুন, যে সকল সুকৃতিশালী ব্যক্তি আমাকে ভজনা করেন, তাহারা চতুর্ব্বিধ - আর্ত্ত, জিজ্ঞাসু, অর্থাথী এবং জ্ঞানী।

চতুর্ব্বিধ ভক্ত - পূর্ব্ব শ্লোকে যাহারা ভগবদ্‌বহির্ম্মূখ, পাষণ্ডী, তাহাদিগের কথা বলা হইয়াছে। এই শ্লোকে যে সুকৃতিশালী ব্যক্তিগণ ভগবানে ভক্তিমান্‌ তাঁহাদিগের কথা বলা হইল। ইহারা চতুর্ব্বিধ - (১) আর্ত্ত - রোগাদিতে ক্লিষ্ট অথবা অন্যরূপে বিপন্ন; যেমন - কুরুসভায় দ্রৌপদী। (২) জিজ্ঞাসু - অর্থাৎ আত্মজ্ঞান লাভেচ্ছু; যেমন মুকুন্দ, রাজর্ষি জনক ইত্যাদি। (৩) অর্থার্থ- ইহকালে বা পরলোকে ভোগ-সুখ লাভার্থ যাঁহারা ভজনা করেন; যেমন - সুগ্রীব, বিভীষণ, উপমন্যু, ধ্রুব ইত্যাদি। (৪) জ্ঞানী - তত্ত্বদর্শী, শ্রীভগবান্‌কে তত্ত্বতঃ যাঁহারা জানিয়াছেন- যেমন, প্রহ্লাদ, শুক, সনক ইত্যাদি। ইহাদিগের মধ্যে প্রথম তিন প্রকার ভক্ত সকাম। ব্রজগোপিকাদি নিস্কাম প্রেমিক ভক্ত।

তেষাং জ্ঞানী নিত্যযুক্ত একভক্তির্বিশিষ্যতে
প্রিয়ো হি জ্ঞানিনোহত্যর্থমহং স চ মম প্রিয়ঃ।।১৭

অর্থঃ- (১৭) ইহাদিগের মধ্যে জ্ঞানী ভক্তই শ্রেষ্ঠ। তিনি সতত আমাতেই যুক্তচিত্ত এবং একমাত্র আমাতেই ভক্তিমান্‌। আমি জ্ঞানীর অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও আমার অত্যন্ত প্রিয়।

উদারাঃ সর্ব্ব এবৈতে জ্ঞানী তাত্মৈব মে মতম্
আস্থিতঃ স হি যুক্তাত্মা মামেবানুত্তমাং গতিম্।।১৮

অর্থঃ- (১৮) ইহারা সকলেই মহান্‌। কিন্তু জ্ঞানী আমার আত্মস্বরূপ, ইহাই আমার মত; যেহেতু মদেকচিত্ত সেই জ্ঞানী সর্ব্বোৎকৃষ্ট গতি যে আমি সেই আমাকেই আশ্রয় করিয়া থাকেন।

সকাম ভক্তগণকাম্য বস্তুর লাভার্থেই আমার ভজনা করিয়া থাকেন। কাম্য বস্তুও তাঁহাদের প্রিয়, আমিও তাঁহাদের প্রিয়। কিন্তু মদ্ব্যতিরিক্ত জ্ঞানীর অন্য কাম্যবস্তু নাই। আমিই তাঁহার একমাত্র গতি, সুহৃদ ও আশ্রয়। আমি তাঁহার আত্মস্বরূপ। সুতরাং তিনিও আমার আত্মস্বরূপ, কেননা, যে ভক্ত আমাকে যেরূপ প্রীতি করে আমিও তাহাকে সেইরূপ প্রীতি করিয়া থাকি।
 
বহুনাং জন্মনামন্তে জ্ঞানবান্মাং প্রপদ্যতে
বাসুদেবঃ সর্ব্বমিতি স মহাত্মা সুদুর্লভঃ।।১৯

অর্থঃ- (১৯) জ্ঞানী ভক্ত অনেক জন্মের পর বাসুদেবই সমস্ত এইরূপ জ্ঞান লাভ করিয়া আমাকে প্রাপ্ত হন; এইরূপ মহাত্মা অতি দুর্লভ।

কামৈস্তৈস্তৈর্হৃতজ্ঞানাঃ প্রপদ্যন্তেহন্যদেবতাঃ
তং তং নিয়মমাস্থায় প্রকৃত্যা নিয়তাঃ স্বয়া।।২০

অর্থঃ- (২০) (স্ত্রীপুত্র ধনমানাদি বিবিধ) কামনাদ্বারা যাহাদের বিবেক অপহৃত হইয়াছে, তাহারা নিজ নিজ কামনা-কলুষিত স্বভাবের বশীভূত হইয়া ক্ষুদ্র দেবতাদের আরাধনায় ব্রতোপবাসাদি যে সকল নিয়ম আছে তাহা পালন করিয়া অন্য দেবতার ভজনা করিয়া থাকে। (আমার ভজনা করে না)।

যো যো যাং যাং তনুং ভক্তঃ শ্রদ্ধয়ার্চ্চিতুমিচ্ছতি
তস্য তস্যাচলাং শ্রদ্ধাং তামেব বিদধাম্যহম্।।২১

অর্থঃ- (২১) যে যে সকাম ব্যক্তি ভক্তিযুক্ত হইয়া শ্রদ্ধাসহকারে যে যে দেবমূর্ত্তি অর্চ্চনা করিতে ইচ্ছা করে, আমি (অন্তর্য্যামিরূপে) সেই সকল ভক্তের সেই সেই দেবমূর্ত্তিতে ভক্তি অচলা করিয়া দেই।

স তয়া শ্রদ্ধয়া যুক্তস্তস্যারাধনমীহতে
লভতে চ ততঃ কামান্ ময়ৈব বিহিতান্ হি তান্।।২২

অর্থঃ- (২২) সেই দেবোপাসক মৎবিহিত শ্রদ্ধাযুক্ত হইয়া সেই দেবমূর্ত্তির অর্চ্চনা করিয়া থাকে এবং সেই দেবতার নিকট হইতে নিজ কাম্যবস্তু লাভ করিয়া থাকে, সেই সকল আমাকর্ত্তৃকই বিহিত (কেননা সেই সকল দেবতা আমারই অঙ্গস্বরূপ)।

অন্তবত্তু ফলং তেষাং তদ্ভবত্যল্পমেধসাম্
দেবান্ দেবযজো যান্তি মদ্ভক্তা যান্তি মামপি।।২৩

অর্থঃ- (২৩) কিন্তু অল্পবুদ্ধি সেই দেবোপাসকগণের আরাধনালব্ধ ফল বিনাশশীল দেবোপাসকগণ দেবলোক প্রাপ্ত হন, আর আমার ভক্তগণ আমাকেই লাভ করিয়া থাকেন।

অব্যক্তং ব্যক্তিমাপন্নং মন্যন্তে মামবুদ্ধয়ঃ
পরং ভাবমজানন্তো মমাব্যয়মনুত্তমম্।।২৪

অর্থঃ- (২৪) অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ আমার নিত্য সর্ব্বোৎকৃষ্ট পরম স্বরূপ জানায় অব্যক্ত আমাকে প্রাকৃত ব্যক্তিভাবাপন্ন মনে করে।

নাহং প্রকাশঃ সর্ব্বস্য যোগমায়াসমাবৃতঃ
মূঢ়োহয়ং নাভিজানাতি লোকো মামজমব্যয়ম্।।২৫

অর্থঃ- (২৫) আমি যোগমায়ায় সমাচ্ছন্ন থাকায় সকলের নিকট প্রকাশিত হই না। অতএব মূঢ় এই সকল লোক জন্মমরণরহিত আমাকে পরমেশ্বর বলিয়া জানিতে পারে না।

বেদাহং সমতীতানি বর্ত্তমানানি চার্জ্জুন
ভবিষ্যাণি চ ভূতানি মান্তু বেদ ন কশ্চন।।২৬

অর্থঃ- (২৬) হে অর্জ্জুন, আমি ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান সমস্ত পদার্থকে জানি; কিন্তু আমাকে কেহই জানে না।

আমি সর্ব্বজ্ঞ, কেননা আমি মায়ার অধীন নহি, আমি মায়াধীশ। কিন্তু জীব মায়াধীন, সুতরাং অজ্ঞ। কেবল আমার অনুগৃহীত ভক্তগণই আমার মায়া ঊত্তীর্ণ হইয়া আমাকে জানিতে পারে।

ইচ্ছাদ্বেষসমুত্থেন দ্বন্দ্বমোহেন ভারত
সর্ব্বভূতানি সম্মোহং সর্গে যান্তি পরন্তপ।।২৭

অর্থঃ- (২৭) হে ভারত, হে পরন্তপ, সৃষ্টিকালে অর্থাৎ স্থূলদেহ উৎপন্ন হইলেই প্রাণিগণ রাগদ্বেষজনিত সুখ-দুঃখাদি দ্বন্দ্ব কর্তৃক মোহ প্রাপ্ত হইয়া হতজ্ঞান হয় (সুতরাং আমাকে জানিতে পারে না)।

যেষাং ত্বন্তগতং পাপং জনানাং পুণ্যকর্ম্মণাম্
তে দ্বন্দ্বমোহনির্ম্মুক্তা ভজন্তে মাং দৃঢ়ব্রতাঃ।।২৮

অর্থঃ- (২৮) কিন্তু পুণ্যকর্ম্ম দ্বারা যাহাদের পাপ বিনষ্ট হইয়াছে, সেই সকল দ্বন্দ্বমোহনির্ম্মুক্ত ধীরব্রত ব্যক্তি আমাকে ভজনা করিয়া থাকেন।

জরামরণমোক্ষায় মামাশ্রিত্য যতন্তি যে
তে ব্রহ্ম তদ্ বিদুঃ কৃৎস্নমধ্যাত্মং কর্ম্ম চাখিলম্।।২৯

অর্থঃ- (২৯) যাহারা আমাতে চিত্ত সমাহিত করিয়া জরামরণ হইতে মুক্তি লাভের জন্য যত্ন করেন, তাহারা সেই সনাতন ব্রহ্ম, সমগ্র অধ্যাত্মবিষয় এবং সমস্ত কর্ম্মতত্ত্ব অবগত হন।

সাধিভূতাধিদৈবং মাং সাধিযজ্ঞঞ্চ যে বিদুঃ
প্রয়াণকালেহপি চ মাং তে বিদুর্যুক্তচেতসঃ।।৩০

অর্থঃ- (৩০) যাহারা অধিভূত, অধিদৈব এবং অধিযজ্ঞের সহিত আমাকে (অর্থাৎ আমার এই সকল বিভিন্ন বিভাবসহ সমগ্র আমাকে) জানেন, সেই সকল ব্যক্তি আমাতে আসক্তচিত্ত হওয়ায় মৃত্যুকালে আমাকে জানিতে পারেন। মরণকালে মূর্চ্ছিত হইয়াও আমাকে বিস্মৃত হন না। (সুতরাং মদ্ভক্তগণের মুক্তিলাভের কোন বিঘ্ন নাই)।

ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুনসংবাদে জ্ঞান-বিজ্ঞান-যোগো নাম সপ্তমোহধ্যায়ঃ।



No comments:

Post a Comment