শ্রীভগবানুবাচ
–
অভয়ং সত্ত্বসংশুদ্ধির্জ্ঞানযোগব্যবস্থিতিঃ।
দানং
দমশ্চ যজ্ঞশ্চ স্বাধ্যায়স্তপ আর্জ্জবম্।।১
অহিংসাসত্যমক্রোধস্ত্যাগঃ
শান্তিরপৈশুনম্।
দয়া
ভূতেষ্বলোলুপ্ত্বং মার্দ্দবং হ্রীরচাপলম্।।২
তেজঃ
ক্ষমা ধৃতিঃ শৌচমদ্রোহো নাতিমানিতা।
ভবন্তি
সম্পদং দৈবীমভিজাতস্য ভারত।।৩
সত্ত্বসংশুদ্ধি – অন্তঃকরণের শুদ্ধ ভাব অর্থাৎ চিত্ত-শুদ্ধি (শঙ্কর), শুদ্ধ
সাত্ত্বিইকবৃত্তি (তিলক)।
জ্ঞানযোগব্যবস্থিতি – জ্ঞানযোগে একান্তনিষ্ঠা (শঙ্কর, শ্রীধর); জ্ঞান ও কর্ম্মযোগে যুগপৎ
অবস্থিতি (তিলক, ৪।৪১ – ৪২ – শ্লোক দ্রষ্টব্য)। অহিংসা, সত্য।
শৌচ, তপঃ, স্বাধ্যায়। নাতিমানিতা – আমি অতিশয় পূজ্য – এইরূপ আভিমান বর্জ্জন।
অর্থঃ-(১।২।৩) নির্ভীকতা, চিত্তশুদ্ধি, আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা ও কর্ম্মযোগে
তৎপরতা, দান, বাহ্যেন্দ্রিয় সংযম, যজ্ঞ, শাস্ত্র-অধ্যয়ন, তপঃ, সরলতা, অহিংসা,
সত্য, অক্রোধ, ত্যাগ, শান্তি, পরনিন্দাবর্জ্জন, জীবে দয়া, লোভহীনতা, মৃদুতা
(অক্রৌর্য্য), কু-কর্ম্মে লজ্জা, অচাঞ্চল্য, তেজস্বিতা, ক্ষমা, ধৃতি, শৌচ, দ্রোহ
বা হিংসা না করা, অভিমান – হে ভারত, এই সকল গুণ দৈবী সম্পদ অভিমুখে জাত পুরুষের হইয়া থাকে। (অর্থাৎ
যাঁহারা পূর্ব্বজন্মের কর্ম্মফলে দৈবী সম্পদ্ ভোগার্থ জন্মগ্রহণ করেন তাঁহাদেরই
এই সকল সাত্ত্বিক গুণ জন্মিয়া থাকে)।
সপ্তম অধ্যায়ে যে জ্ঞান-বিজ্ঞানের কথা আরম্ভ হইয়াছিল, পঞ্চদশ অধ্যায়ের উহা
শেষ হইল এবং পরিশেষে ভগবান্ পুরুষোত্তমরূপে আত্মপরিচয় দিয়া বলিলেন, যে এই গুহ্য
তত্ত্ব বুঝিতে পারে সে জ্ঞানী ও কৃতার্থ হয়। কিন্তু নবম অধ্যায়ে সংক্ষেপে বলিয়াছেন
যে, আসুরিক প্রকৃতির লোক তাঁহাকে চিনে না, সুতরাং অবজ্ঞা করে; দৈবী বা সাত্ত্বিক
প্রকৃতির লোক তাঁহাকে ভক্তি করে (৯।১১।১৩ শ্লোক)। এই উভয় প্রকৃতির বিস্তারিত বর্ণনা এই অধ্যায়ে করা হইতেছে এবং আসুরী প্রকৃতির
কিরূপে সংশোধন হয় তাহাও উপদেশ দেওয়া হইয়াছে।
প্রথমতঃ এই অধ্যায়ের প্রথম তিন শ্লোকে দৈবী সম্পদ্ বা সাত্ত্বিক গুণ
বর্ণিত হইয়াছে। এই ছাব্বিশটি সাত্ত্বিকগুণ এবং ত্রয়োদশ অধ্যায়োক্ত কুড়িটি জ্ঞানীর
লক্ষণ প্রায়ই। কেননা, জ্ঞান সত্ত্বগুণেরই ধর্ম। এই হেতুই পরবর্ত্তী শ্লোকে
অজ্ঞানকে আসুরী সম্পদের অন্তর্ভূক্ত করা হইয়াছে।
দম্ভো
দর্পোহভিমানশ্চ ক্রোধঃ পারুষ্যমেবচ।
অজ্ঞানং
চাভিজাতস্য পার্থ সম্পদমাসুরীম্।।৪
অর্থঃ-(৪) হে পার্থ, দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নিষ্ঠুরতা এবং অজ্ঞান
আসুরী সম্পদ অভিমুখে জাত ব্যক্তি প্রাপ্ত হয় অর্থাৎ এই সকল রাজসিক এবং তামসিক
প্রকৃতির লোকের ধর্ম্ম।
দৈবী
সম্পদ্বিমোক্ষায় নিবন্ধায়াসুরী মতা।
মা শুচঃ
সম্পদং দৈবীমভিজাতোহসি পাণ্ডব।।৫
অর্থঃ-(৫) দৈবী সম্পদ্ মোক্ষের হেতু এবং আসুরী সম্পদ্ সংসার বন্ধনের কারণ
হয়। হে পাণ্ডব, শোক করিও না; কারণ তুমি দৈবী সম্পদ্ অভিমুখে জন্মিয়াছ।
দ্বৌ
ভূতসর্গৌ লোকেহস্মিন্ দৈব আসুর এব চ।
দৈবো
বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু।।৬
অর্থঃ-(৬) হে পার্থ, এই জগতে দৈব ও আসুর এই দুই প্রকার প্রাণীর সৃষ্টি হয়।
দৈবী প্রকৃতির বর্ণনা সবিস্তার করিয়াছি, এক্ষণে, আসুরী প্রকৃতির কথা আমার নিকট
শ্রবণ কর।
দৈবী প্রকৃতির বর্ণনা এই অধ্যায়ের প্রথম তিন শ্লোকে বিস্তৃতভাবে করা
হইয়াছে। অধিকন্তু দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্থিতপ্রজ্ঞের বর্ণনা (২।৫৫ – ৭২), দ্বাদশ অধ্যায়ে ভগবদ্ভক্তের
বর্ণনা (১২। ১৩ – ২০),
ত্রয়োদশ অধ্যায়ে জ্ঞানীর লক্ষণ (১৩। ৮ – ১২), চতুর্দ্দশ অধ্যায়ে ত্রিগুণাতীতের বর্ণনা (১৭।২২ – ২৫) এ সকলই দৈবী সম্পদের বর্ণনা।
কিন্তু আসুরী সম্পদের বর্ণনা মাত্র নবম অধ্যায়ে সংক্ষেপে উল্লিখিত হইয়াছে (৯।১১ – ১২)। এক্ষণে উহাই এই অধ্যায়ে
বিস্তৃতভাবে বলিতেছেন।
প্রবৃত্তিঞ্চ
নিবৃত্তিঞ্চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ।
ন শৌচং
নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে।।৭
অর্থঃ-(৭) অসুর-ভাবাপন্ন ব্যক্তিগণ জানে না যে ধর্ম্মে প্রবৃত্তিই বা কি আর
অধর্ম্ম হইতে নিবৃতিই বা কি অর্থাৎ তাহাদের ধর্ম্মাধর্ম্ম, কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য
জ্ঞান নাই। অতএব তাহাদের মধ্যে শৌচ, সদাচার বা সত্য কিছুই নাই।
অসত্যমপ্রতিষ্ঠং
তে জগদাহুরনীশ্বরম্।
অপরস্পরসম্ভুতং
কিমন্যৎ কামহৈতুকম্।।৮
অর্থঃ-(৮) এই অসুর প্রকৃতির লোকেরা বলিয়া থাকে যে এই জগতে সত্য বলিয়া কোন
পদার্থ নাই, সকলই অসত্য; জগতে ধর্ম্মাধর্ম্মেরও কোন ব্যবস্থা নাই এবং
ধর্ম্মাধর্ম্মের ব্যবস্থাপক ঈশ্বর বলিয়াও কোন বস্তু নাই। ইহা কেবল স্ত্রী-পুরুষ অন্যোন্যসংযোগে
জাত। স্ত্রী-পুরুষের কামই ইহার একমাত্র কারণ, ইহার অন্য কারণ নাই (অথবা মতান্তরে,
জগতের শাস্ত্রোক্ত কোন সৃষ্টি-পরম্পরা নাই)। জগতের সকল পদার্থই মনুষ্যের কামনা
বাসনা তৃপ্ত করিবার জন্য। তাহাদের অন্য কোনও উপযোগ নাই।
এতাং
দৃষ্টিমবষ্টভ্য নষ্টাত্মানোহল্পবুদ্ধয়ঃ।
প্রভবন্ত্যুগ্রকর্ম্মাণঃ
ক্ষরায় জগতোহহিতাঃ।৯
এতাং দৃষ্টিং অবষ্টভ্য – এইরূপ নিরীশ্বরবাদীদিগের দৃষ্টি বা মত অবলম্বন করিয়া (holding this view – Annie Besant)।
অর্থঃ-(৯) পূর্ব্বোক্ত দৃষ্টি (নিরীশ্বরবাদীদিগের মত) অবলম্বন
করিয়া বিকৃতমতি, অল্পবুদ্ধি, ক্রুরকর্ম্মা
ব্যক্তিগণ অহিতাচরণে প্রবৃত্ত হয়, তাহারা জগতের বিনাশের
জন্যই জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে।
কামমাশ্রীত্য
দুষ্পুরং দম্ভমানমদান্বিতাঃ।
মোহাদ্
গৃহীত্বাসদ্ গ্রাহান্ প্রবর্ত্তন্তেশুচিব্রতাঃ।।১০
অর্থঃ-(১০) যাহা কখনও পূর্ণ হইবার নহে, এইরূপ কামনার বশীভূত হইয়া দম্ভ,
অভিমান ও গর্ব্বে মত্ত হইয়া, তন্ত্রমন্ত্রাদি দ্বারা স্ত্রীরত্নাদি প্রাপ্ত হইব,
অবিবেকবশতঃ এইরূপ দুরাশার বশবর্ত্তী হইয়া অশুচিব্রত অবলম্বন করত তাহারা কর্ম্মে (ক্ষুদ্র দেবতাদির উপাসনায়) প্রবৃত্ত হইয়া থাকে।
চিন্তামপরিমেয়াঞ্চ
প্রলয়ান্তামুপাশ্রিতাঃ।
কামোপভোগপরমা
এতাবদিতি নিশ্চিতাঃ।।১১
আশাপাশশতৈর্ব্বদ্ধাঃ
কামক্রোধপরায়ণাঃ।
ঈহন্তে
কামভোগার্থমন্যায়েনার্থসঞ্চয়ান্।।১২
অর্থঃ-(১১।১২) মৃত্যুকাল পর্য্যন্ত অপরিমেয় বিষয়চিন্তা আশ্রয় করিয়া (যাবজ্জীবন নিরন্তর বিষয়চিন্তাপরায়ণ
হইয়া) বিষয়ভোগনিরত এই সকল ব্যক্তি নিশ্চয় করে যে
কামোপভোগই পরম পুরুষার্থ, এতদ্ব্যতীত জীবনের অন্য লক্ষ্য
নাই, সুতরাং ইহারা শত শত আশাপাশে বদ্ধ এবং কামক্রোধপরায়ণ
হইয়া অসৎ মার্গ অবলম্বনপূর্ব্বক অর্থ সংগ্রহে সচেষ্ট হয়।
ইদমদ্য
ময়া লব্ধমিমং প্রাপ্স্যে মনোরথম্।
ইদমস্তীদমপি
মে ভবিষ্যতি পুনর্ধনম্।।১৩
অসৌ ময়া
হতঃ শত্রুর্হনিষ্যে চাপরানপি।
ঈশ্বরোহহমহং
ভোগী সিদ্ধোহহং বলবান্ সুখী।।১৪
আঢ্যোহভিজনবানস্মি
কোহন্যোহস্তি সদৃশো ময়া।
যক্ষ্যে
দাস্যামি মোদিষ্য ইত্যজ্ঞানবিমোহিতাঃ।।১৫
অনেকচিত্তবিভ্রান্তা
মোহজালসমাবৃতাঃ।
প্রসক্তাঃ
কামভোগেষু পতন্তি নরকেহশুচৌ।।১৬
অর্থঃ-(১৩।১৪।১৫।১৬) অদ্য আমার এই লাভ হইল, পরে
এই ইষ্ট বস্তু পাইব, এই ধন আমার আছে, এই ধন আমার পরে হইবে, এই শত্রুকে আমি পরাজিত
করিয়াছি, অন্যান্যকেও হত করিব; আমিই সকলের প্রভু, আমিই সকল ভোগের আধিকারী, আমি
কৃতকৃত্য, আমি বলবান্, আমি সুখী, আমি ধনবান্, আমি কুলীন, আমার তুল্য আর কে আছে?
আমি যজ্ঞ করিব, দান করিব, মজা করিব – এই
প্রকার অজ্ঞানে বিমূঢ় বিবিধ বিষয় চিন্তায় বিভ্রান্তচিত্ত, মোহজালে জড়িত, বিষয় ভোগে
আসক্ত ব্যক্তিগণ অপবিত্র নরকে পতিত হয়।
আত্মসম্ভাবিতাঃ
স্তব্ধা ধনমানমদান্বিতাঃ।
যজন্তে
নামযজ্ঞৈস্তে দম্ভেনাবিধিপূর্ব্বকম্।।১৭
অর্থঃ-(১৭)
আত্মশ্লাঘাযুক্ত, অবিনয়ী, ধনমানের গর্ব্বে বিমূঢ় সেই আসুর প্রকৃতির ব্যক্তিগণ দম্ভ
প্রকাশ করিয়া অবিধিপূর্ব্বক নামমাত্র যজ্ঞ করে।
অহঙ্কারং
বলং দর্পং কামং ক্রোধং চ সংশ্রিতাঃ।
মামাত্মপরদেহেষু
প্রদ্বিষন্তোহভ্যসূয়কাঃ।।১৮
অর্থঃ-(১৮) সাধুগণের অসূয়াকারী সেই সকল ব্যক্তি অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম ও
ক্রোধের বশীভূত হইয়া স্বদেহে ও পরদেহে অবস্থিত আত্মরূপী আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে।
স্বদেহে ও পরদেহে আমাকে দ্বেষ করিয়া থাকে – একথার তাৎপর্য্য এই যে আমি
অন্তর্য্যামিরূপে সকলের মধ্যেই আছি, কিন্তু দম্ভবশে আমার অন্তর্য্যামিত্ত্ব অস্বীকার
করিয়া স্বদেহস্থিত আমাকে দ্বেষ করে এবং প্রাণি-হিংসাদি দ্বারা অন্য দেহেও আমাকে
দ্বেষ করিয়া থাকে।
তানহং
দ্বিষতঃ ক্রুরান্ সংসারেষু নরাধমান্।
ক্ষিপাম্যজস্রমশুভানাসুরীষ্বেব
যোনিষু।।১৯
অর্থঃ-(১৯) এইরূপ
দ্বেষপরবশ, ক্রুরমতি নরাধম, আসুর পুরুষগণকে আমি সংসারে (ব্যাঘ্র-সর্পাদি) আসুরী
যোনিতে পুনঃ পুনঃ নিক্ষেপ করিয়া থাকি।
আসুরীং
যোনিমাপন্না মূঢ়া জন্মনি জন্মনি।
মামপ্রাপ্যৈব
কৌন্তেয় ততো যান্ত্যধমাং গতিম্।।২০
অর্থঃ-(২০) হে কৌন্তেয়, এই সকল মূঢ় ব্যক্তি জন্মে জন্মে আসুরী যোনি প্রাপ্ত
হয় এবং আমাকে না পাইয়া শেষে আরও অধোগতি (ক্রিমিকীটাদি যোনি) প্রাপ্ত হয়।
৪র্থ হইতে ২০শ শ্লোক পর্য্যন্ত আসুরী প্রকৃতির
লোকদিগের এবং তাহাদের অধোগতির বর্ণনা হইয়া গেল। এক্ষণে এই অধোগতির মূল কারণ কি এবং
তাহা নিবারণের উপায় কি তাহাই বলা হইতেছে।
ত্রিবিধং
নরকস্যেদং দ্বারং নাশনমাত্মনঃ।
কামঃ
ক্রোধস্তথা লোভস্তস্মাদেতত্রয়ং ত্যজেৎ।।২১
অর্থঃ-(২১) কাম, ক্রোধ এবং লোভ – এই তিনটি নরকের দ্বার-স্বরূপ, ইহারা আত্মার বিনাশের মূল (জীবের অধোগতির
কারণ)। সুতরাং এই তিনটিকে ত্যাগ করিবে।
এতৈর্বিমুক্তঃ
কৌন্তেয় তমোদ্বারৈর্স্ত্রিভির্নরঃ।
আচরত্যাত্মনঃ
শ্রেয়স্ততো যাতি পরাং গতিম্।।২২
অর্থঃ-(২২) হে কৌন্তেয়, নরকের দ্বারস্বরূপ এই তিনটি (কাম, ক্রোধ ও লোভ)
হইতে মুক্ত হইলে মানুষ আপনার কল্যাণ সাধনপূর্ব্বক পরম গতি প্রাপ্ত হয়।
দম্ভ, দর্প, অভিমানাদি আসুর স্বভাবের যে সকল দোষ উল্লিখিত হইয়াছে সে সকলেরই
মূলে কাম, ক্রোধ ও লোভ এই তিনটি দোষ আছে। এই তিনটিকে ত্যাগ করিতে পারিলেই আপনার
শ্রেয়ঃ সাধনার্থ কর্ম্ম করা যায় এবং তজ্জন্য পরিশেষে মোক্ষও লাভ হয়। কি উপায়ে
ইহাদিগকে ত্যাগ করা যায় এবং আপনার শ্রেয়ঃসাধন কর্ম্ম কি? (পরের দুই শ্লোক)।
যঃ
শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য বর্ত্ততে কামকারতঃ।
ন স
সিদ্ধিমবাপ্নোতি ন সুখং ন পরাং গতিম্।।২৩
অর্থঃ-(২৩) যে ব্যক্তি শাস্ত্রবিধি ত্যাগ করিয়া স্বেচ্ছাচারী হইয়া কর্ম্মে
প্রবৃত্ত হয়, সে সিদ্ধিলাভ করিতে পারে না, তাহার শান্তিসুখও হয় না, মোক্ষ লাভও হয়
না।
তস্মাচ্ছাস্ত্রং
প্রমাণং তে কার্য্যাকার্য্যব্যবস্থিতৌ।
জ্ঞাত্বা
শাস্ত্রবিধানোক্তং কর্ম্ম কর্ত্তুমিহার্হসি।।২৪
অর্থঃ-(২৪) স্থূল করা এই যে, স্বধর্ম্মাচরণ না করিয়া স্বেচ্ছাচারের
অনুবর্ত্তী হইলে কামক্রোধাদি ত্যাগ করা যায় না, স্বধর্ম্মাচরণেই সংসুদ্ধি, সম্যক্
জ্ঞান ও মোক্ষ লাভ হয়। তোমার স্বধর্ম্ম কি সে বিষয়ে শাস্ত্রই প্রমাণ, সুতরাং
শাস্ত্রীয় বিধান মানিয়া তদনুসারে কর্ম্ম কর।
শ্রীভগবান্ ১৫শ অধ্যায়ের শেষে বলিয়াছেন, যে আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানে
সে-ই জ্ঞানী ও কৃতকৃত্য হয়। কিন্তু নবম অধ্যায়ে সংক্ষেপে বলিয়াছেন যে, আসুরী
প্রকৃতির লোক তাঁহার প্রকৃত স্বরূপ জানে না, তাহারা বিবিধ কামনার বশবর্ত্তী হইইয়া
দম্ভাদি সহকারে যাগযজ্ঞ অনুশঠান ও ক্ষুদ্র দেবতাদির আরাধনা করে। কিন্তু সাত্ত্বিক
প্রকৃতির লোক তাঁহার প্রকৃত তত্ত্ব জানিয়া তাঁহারই আরাধনা করে। কিন্তু সাত্ত্বিক
প্রকৃতির লোক তাঁহার প্রকৃত তত্ত্ব জানিয়া তাঁহারই ভজন-পূজন করেন। দৈব
(সত্ত্বপ্রধান) ও আসুর (রজস্তমোপ্রধান) এই দ্বিবিধ স্বভাব বা সম্পদ্ লইয়া জীব
জন্মগ্রহণ করে, এই দ্বিবিধ স্বভাবের বিস্তারিত বর্ণনা এই অধ্যায়ে করা হইয়াছে।
দৈবী সম্পদ্ - প্রথম তিনটি শ্লোকে ভয়াভাব, চিত্তশুদ্ধি, আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা
প্রভৃতি দৈবী প্রকৃতির ২৬টি গুণ নির্দ্দেশ করা হইয়াছে। এই গুলি মোক্ষপথের সহায়।
অর্জ্জুন দৈবী সম্পদ্ লইয়া জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। সুতরাং শ্রীভগবান্ বলিতেছেন,
তাঁহার শোকের কারণ নাই।
আসুর-প্রকৃতি লোকের স্বভাব – দম্ভ, দর্প, অভিমান, ক্রোধ, নির্দ্দয়তা ও অজ্ঞান – এগুলি আসুরী সম্পদ্ অর্থাৎ রজস্তমোগুণাক্রান্ত লোকের স্বভাব। এ সকল বন্ধনের কারণ। আসুরী প্রকৃতির লোকের
ধর্ম্মাধর্ম্ম, কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য জ্ঞান নাই। তাহারা শৌচ ও সদাচার জানে না,
তাহারা সত্য, ধর্ম্ম, শাস্ত্র, গুরু, ঈশ্বর বলিয়া কিছু মানে না। এই সকল বিকৃতমতি,
ক্রুরকর্ম্মা অসুরগণ জগতের বিনাশের জন্যই উৎপন্ন হয়। কামোপভোগই ইহাদের পরম
পুরুষার্থ। ইহারা শত শত আশা-পাশে বন্ধ হইয়া আজীবন বিষয়-সেবায় রত থাকে এবং অসৎ
মার্গ অবলম্বন করিয়া অর্থসংগ্রহে সচেষ্ট হয়। ইহারা সতত দম্ভ করিয়া বলে – আমি প্রভু, আমি ধনী, মানী, আমি যজ্ঞ করি, দান করি, আড়ম্বর করি – ইহাদের "আমিই" সব। এই আত্মশ্লাঘাযুক্ত, ধনমানমদান্বিত মূঢ়গণ
অহঙ্কার, বল, দর্প, কাম ও ক্রোধের বশীভূত হইয়া সর্ব্বভূতের অহিতসাধনে রত হয়। এই
মূঢ়মতি আসুর প্রকৃতির লোকগণ পুনঃ পুনঃ আসুরযোনি প্রাপ্ত হয় এবং ক্রমশঃ অধোগতি লাভ
করে।
আসুর
স্বভাবের মূল কারণ – দম্ভ, দর্প, হিংসা, দ্বেষ প্রভৃতি আসুর স্বভাবের যে সকল
দোষ উল্লিখিত হইল, কাম, ক্রোধ, লোভ –
তিনটিই উহার মূল কারণ। এই তিনটি নরকের দ্বারস্বরূপ, এই তিনটি ত্যাগ করিতে পারিলেই
স্বভাবের সংশোধন হইয়া শ্রেয়োলাভ হয়।
শাস্ত্রবিধির
প্রয়োজনীয়তা – কি প্রকারে জীবন পরিচালনা করিলে কাম, ক্রোধ, লোভাদি জয়
করিয়া নিজের পারলৌকিক বা আধ্যাত্মিক মঙ্গল ও সমাজের হিতসাধন করা যায় তাহাই
শাস্ত্রে নির্দ্দিষ্ট হইয়াছে। সমাজের স্বেচ্ছাচারিতা ও উচ্ছৃঙ্খলতা নিবারণপূর্ব্বক
ধর্ম্ম ও লোকরক্ষার উদ্দেশ্যেই শাস্ত্রবিধি প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। সুতরাং
শাস্ত্রবিহিতি কর্ম্ম করা প্রত্যেকেরই কর্ত্তব্য। ধর্ম্মাধর্ম্ম নির্ণয়ে শাস্ত্রই
প্রমাণ।
(দেশ-কাল-পাত্র
ভেদে বিভিন্ন সামাজিক অবস্থার পরিবর্ত্তনের সঙ্গে শাস্ত্রবিধির পরিবর্ত্তন হয়,
এইরূপ পরিবর্ত্তন ব্যাতীত সমাজ রক্ষা হয় না, উহাই যুগধর্ম্ম; শাস্ত্রবিধি অনুসারে
কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য নির্ণয়ে এদিকেও দৃষ্টি রাখা আবশ্যক।)
এই অধ্যায়ে দৈব ও আসুর সম্পদের বিস্তারিত বর্ণনা করা হইয়াছে। এই হেতু ইহাকে
দৌবাসুর-সম্পদ্-বিভাগ-যোগ বলে।
ইতি শ্রীমদ্ভগব্দগীতাসুপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং যোগশাস্ত্রে
শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন সংবাদে দৈবাসুর-সম্পদ্-বিভাগযোগো নাম ষোড়শোহধ্যায়ঃ।।