শ্রীভগবানুবাচ
-
ঊর্দ্ধমূলমধঃশাখমশ্বত্থং প্রাহুরব্যয়ম্।
ছন্দাংসি যস্য পর্ণানি যস্তং বেদ স বেদবিৎ।।১
ঊর্দ্ধমূলং- ঊর্দ্ধমুত্তমঃ ক্ষরাক্ষরাভ্যামুৎকৃষ্টঃ
পুরুষোত্তমঃ মূলং যস্য তম্ (শ্রীধর) –
ঊর্দ্ধ অর্থাৎ ক্ষর ও অক্ষর হইতেও শ্রেষ্ঠ পুরুষোত্তম যাহার মূল। পুরুষোত্তম বা পরমাত্মা
হইতেই সংসারের সৃষ্টি, উহার মূলকারণ তিনিই।
অর্থঃ এস্থলে সংসারকে অশ্বত্থবৃক্ষের সহিত তুলনা
করা হইয়াছে। এই সংসার বৃক্ষ ঊর্দ্ধমূল, কেননা পুরুষত্তম বা পরমাত্মা হইতেই এই বৃক্ষ
উৎপন্ন হইয়াছে। এই হেতু ইহাকে ব্রহ্মবৃক্ষও বলা হয়। এই বৃক্ষের শাখাস্থানিয় মহত্তত্ত্ব,
অহংকার প্রভৃতি পরিণামগুলি ক্রমশঃ অধোগামী, এই হেতু ইহা অধঃশাখ। পুরুষত্তম বা পরব্রহ্ম
হইতে কিরূপে প্রকৃতির বিস্তার হইয়াছে তাহা এইরূপঃ-
পরব্রহ্ম বা
পুরুষোত্তম
|
|
|
১ পুরুষ
|
+
|
১ প্রকৃতি
|
(গীতার পরা প্রকৃতি)
|
|
|
(গীতার অপরা প্রকৃতি)
|
|
১ মহত্তত্ত্ব বা
বুদ্ধিতত্ত্ব
|
|
|
|
|
|
|
১ অহংকার
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
(সত্ত্বগুণের
প্রাবল্যে)
|
|
(তমোগুণের প্রাবল্যে)
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
|
৫ জ্ঞানেন্দ্রিয়
|
৫ কর্ম্মেন্দ্রিয়
|
|
৫ পঞ্চতন্মাত্র
|
|
|
|
|
|
|
৫ পঞ্চ স্থূলভূত
|
|
|
|
|
|
|
|
|
এই সংসারবৃক্ষ
অব্যয়, কারণ ইহা অনাদিকাল হইতে প্রবৃত্ত। বেদত্রয় এই সংসারবৃক্ষের পত্র, কারণ পত্রসমূহ
যেমন বৃক্ষের আচ্ছাদনহেতু রক্ষার কারণ, সেইরূপ বেদত্রয়ও ধর্ম্মাধর্ম্ম প্রতিপাদন দ্বারা
ছায়ার ন্যায় সর্ব্বজীবের রক্ষক ও আশ্রয়স্বরূপ। এই সংসার বৃক্ষকে যিনি জানেন তিনি বেদজ্ঞ,
কারণ সমূল সংসারবৃক্ষকে জানিলে জীব, জগৎ ব্রহ্ম এই তিনেরই জ্ঞান হয়, আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
চতুর্দ্দশ অধ্যায়ের শেষে শ্রীভগবান্ বলেছেন,
যে অনন্যা ভক্তিযোগে আমার সেবা করে, সে ত্রিগুণ অতিক্রম করিয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়;
আমি ব্রহ্মের প্রতিষ্ঠা। ত্রিগুণাতীত হওয়ার অর্থ, এই সংসারপ্রপঞ্চ অতিক্রম করা। ইহাকে
সংসার-ক্ষয় বলে। সুতরাং এই কথাটা বুঝাইবার জন্যই সংসার কি, উহার মূল কারণ কোথায়, এই
অধ্যায়ে প্রথমতঃ তাহাই বর্ণনা করে হয়েছে এবং শেষে সর্ব্বকারণের কারণ যে তিনিই এই কথা
বলিয়া পুরুষোত্তমরূপে শ্রীভগবান্ আত্ম-পরিচয় দিয়েছেন। এই পুরুষোত্তমতত্ত্বই ‘ভাগবত ধর্ম্মের ও গীতার কেন্দ্র-স্বরূপ’।
অধশ্চোর্দ্ধং প্রসৃতাস্তস্যশাখা গুণপ্রবৃদ্ধা বিষয়প্রবালাঃ।
অধশ্চ মূলান্যনুসন্ততানি কর্মানুবন্ধীনি মনুষ্যলোকে।।২
অর্থঃ- (২) সত্ত্বাদি গুণের দ্বারা বিশেষরূপে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত, বিষয়রূপ
তরুণপল্লব-বিশিষ্ট উহার শাখাসকল অধোভাগে ও ঊর্দ্ধভাগে বিস্তৃত। উহার (বাসনারূপ) মূলসমূহ
ধর্ম্মাধর্ম্মরূপ কর্মের কারণ বা প্রসূতি।
তাৎপর্য্য – পূর্ব্ব শ্লোকে সংসারবৃক্ষের বৈদিক বর্ণনার উল্লেখ করা হইয়াছে। এই শ্লোকে
সাংখ্য-দৃষ্টিতে উহারই বিস্তারিত বর্ণনা করা হইয়াছে। এই সংসার প্রকৃতিরই বিস্তার। সুতরাং
ঐ বৃক্ষের শাখা-সকল গুণ-প্রবৃদ্ধ, অর্থাৎ সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ এই তিনগুণের দ্বারা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত।
শব্দ-স্পর্শাদি বিষয়সমূহ উহার প্রবাল বা তরুণপল্লব স্থানীয়। এই হেতু উহা বিষয়-প্রবাল।
উহার শাখাসমূহ ঊর্দ্ধ ও অধোদিকে বিস্তৃত অর্থাৎ কর্ম্মানুসারে জীবসকল অধোদিকে পশ্বাদি
যোনিতে এবং ঊর্দ্ধদিকে দেবাদি যোনিতে প্রাদুর্ভূত হইয়া থাকে। উহার বাসনারূপ মূলসকল
কর্মানুসন্ধি অর্থাৎ ধর্মাধর্ম্মরূপ কর্মের প্রসূতি। এই মূলসকল অধোদিকে মনুষ্য-লোকে
বিস্তৃত রহিয়াছে, কারণ মনুষ্যগণেরই কর্মাধিকার ও কর্ম্মফল বিশেষরূপে প্রসিদ্ধ। পূর্ব্ব
শ্লোকে বলা হইয়াছে, পরমেশ্বরই উহার প্রধান মূল। এই শ্লোকোক্ত মূলগুলি অবান্তর মূল
(ঝুড়ি)। বাসনাদ্বারাই লোক ধর্মাধর্ম্মে প্রবৃত্ত হয়, সুতরাং বাসনাজালই অবান্তর মূল।
ন রূপমস্যেহ তথোপলভ্যতে নান্তো ন চাদির্ন চ সংপ্রতিষ্ঠা।
অশ্বত্থমেনং সুবিরূঢ়মূলমসঙ্গশস্ত্রেণ দৃঢ়েন ছিত্ত্বা।।৩
ততঃ পদং তৎ পরিমার্গিতব্যং যস্মিন্ গতা ন নিবর্ত্তন্তি ভূয়ঃ।
তমেব চাদ্যং পুরুষং প্রপদ্যে যতঃ প্রবৃত্তিঃ প্রসৃতা পূরাণী।।৪
অর্থঃ- (৩।৪) এই সংসারে স্থিত জীবগণ সংসার বৃক্ষের পূর্ব্বোক্ত ঊর্দ্ধমূলাদিরূপ
উপলব্ধি করিতে পারে না; সেইরূপ উহার আদি, অন্ত এবং স্থিতিও উপলব্ধি করিতে পারে না;
এই সুদৃঢ়মূল অশ্বত্থবৃক্ষকে তীব্র বৈরাগ্যরূপ শস্ত্রদ্বারা ছেদন করিয়া, তৎপর যাঁহাকে
প্রাপ্ত হইলে আর পুনর্জ্জন্ম হয় না, যাঁহা হইতে এই সংসার-প্রবৃত্তির বিস্তার হইয়াছে
‘আমি সেই আদি পুরুষের শরণ লইতেছি’ এই বলিয়া তাঁহার অণ্বেষণ
করিতে হইবে।
তাৎপর্য্য – মায়াবদ্ধ জীব এই সংসারের প্রকৃত স্বরূপ যে কি তাহা বুঝিতে পারে না; ইহার
আদি কোথায়, ইহার অন্ত কোথায়, উহার স্থিতি কোথায় অর্থাৎ কি আধার অবলম্বন করিয়া উহা অবস্থিত
আছে, তাহাও সে কিছুই জানে না। বাসনা ত্যাগ না হইলে মায়া দূর হয় না, তত্ত্বজ্ঞান হয়
না। সুতরাং বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রদ্বারা মায়াবন্ধন ছেদন করা কর্ত্তব্য। তৎপর যাহা হইতে
এই সংসার-প্রবৃত্তি বিস্তৃত হইয়াছে, সেই ভক্তবৎসল পরমেশ্বরকেই আশ্রয় করিয়া ঐকান্তিক
ভক্তিসহকারে তাঁহার অণ্বেষণ করিতে হইবে। কারণ তাঁহার কৃপা ব্যতীত ত্রিগুণ অতিক্রম করা
যায় না, সংসারবন্ধন ঘুচে না।
নির্ম্মানমোহা জিতসঙ্গদোষা অধ্যাত্মনিত্যা বিনিবৃত্তকামাঃ।
দ্বন্দ্বৈর্বিমুক্তাঃ সুখদুঃখসংজ্ঞৈর্গচ্ছন্ত্যমূঢ়াঃ পদমব্যয়ং তৎ।।৫
অর্থঃ- (৫) যাঁহাদের অভিমান ও মোহ নাই, যাঁহারা সংসার-আসক্তি জয় করিয়াছেন,
যাহারা আত্মতত্ত্বে নিষ্ঠাবান্, যাঁহাদের কামনা নিবৃত্ত হইয়াছে, যাহারা সুখদুঃখ-সংজ্ঞক
দ্বন্দ্ব হইতে মুক্ত, তাদৃশ বিবেকী পুরুষগণ সেই অব্যয় পদ প্রাপ্ত হন।
ন তদ্ ভাসয়তে সূর্য্যো ন শশাঙ্কো ন পাবকঃ।
যদ্গত্বা ন নিবর্ত্তন্তে তদ্ধাম পরমং মম।।৬
অর্থঃ- (৬) যে পদ প্রাপ্ত হইলে সাধক আর সংসারে প্রত্যাবর্ত্তন করেন না,
যে পদ সূর্য্য, চন্দ্র বা অগ্নি প্রকাশ করিতে পারে না তাহাই আমার পরমস্বরূপ।
তিনি স্বপ্রকাশ। তাঁহার প্রকাশেই জগৎ প্রকাশিত। জড় পদার্থ চন্দ্র-সূর্য্যাদি
তাঁহাকে প্রকাশ করিবে কিরূপে? এই শ্লোকটি প্রায় অক্ষরশঃই শ্বেতাশ্বতর ও কঠোপনিষদে আছে।
মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূতঃ সনাতনঃ।
মনঃষষ্ঠানীন্দ্রিয়াণি প্রকৃতিস্থানি কর্ষতি।।৭
অর্থঃ- (৭) আমায় সনাতন অংশ জীব হইয়া
প্রকৃতিতে অবস্থিত মন ও পাঁচ ইন্দ্রিয়কে সংসারে অর্থাৎ কর্ম্মভূমিতে আকর্ষণ করিয়া
থাকে।
পূর্ব্ব শ্লোকে বলা হইয়াছে
যে, তাঁহাকে প্রাপ্ত হইলে জীবের প্রত্যাবর্ত্তন হয় না। মোক্ষ বা ঈশ্বর প্রাপ্তি না
হওয়া পর্য্যন্ত জীবের পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু, জরাদুঃখাদি ভোগ করিতে হয়। এই কথা
স্পষ্টীকৃত করার উদ্দেশ্যেই জীবের স্বরূপ কি, কিরূপে তাহার উৎক্রমণ হয়, ইত্যাদি
বিষয় এই কয়েকটি শ্লোকে বলা হইতেছে।
জীব ও ব্রহ্মে ভেদ ও
অভেদ – জীব ও ব্রহ্ম
এক, না পৃথক? এ সন্বন্ধে নানারূপ মতভেদ আছে এবং এই সকল মতভেদ লইয়াই দ্বৈতবাদ,
অদ্বৈতবাদ, বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ, দ্বৈতাদ্বৈতবাদ প্রভৃত নানাবিধ মতবাদের সৃষ্টি
হইয়াছে। এ সন্বন্ধে গীতার মত কি তাহাই আমাদের দ্রষ্টব্য। গীতার নানাস্থলেই জীবব্রহ্মৈক্যবাদই
স্বীকৃত হইয়াছে বলিয়া বোধ হয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আত্মার অবিনাশিতা বর্ণনা প্রসঙ্গে
বলা হইয়াছে – জীব অজ, নিত্য
সনাতন, অবিনাশী, অবিকারী, সর্ব্বব্যাপী, অচিন্ত্য, অমেয় ইত্যাদি। অবিকারিত্ব,
সর্ব্বব্যাপিত্ব, উৎপত্তি-বিনাশ-রাহিত্য ইত্যাদি ব্রহ্মেরই লক্ষণ। অন্যত্র
শ্রীভগবান্ বলিতেছেন – আমিই সর্ব্বভূতাশয়াস্থিত আত্মা। আমাকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলিয়া জানিও, আসুরী
প্রকৃতির লোক শরীরস্থ আমাকে কষ্ট দেয় ইত্যাদি। এই সকল স্থলে স্পষ্ট বলা হইয়াছে যে,
ভগবান্ই দেহে জীবরূপে অবস্থিত আছেন। ‘তত্ত্বমসি’, ‘সোহহং’, ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’, ‘অয়মাত্মা ব্রহ্ম’ – চারি বেদের এই
চারিটি মহাবাক্যও এই সত্যই প্রচার করিতেছে যে জীবই ব্রহ্ম। কিন্তু এস্থলে বলা হইল – ‘জীব আমার সনাতন
অংশ’। এ অংশ কিরূপ?
অদ্বৈতবাদী বলেন – ‘ব্রহ্ম অখণ্ড,
অপরিচ্ছিন্ন, নিরবয়ব অদ্বয় বস্তু’, উহার খণ্ডিত অংশ কল্পনা করা যায় না। এস্থলে ‘অংশ’ বলিতে এইরূপ
বুঝিতে হইবে – যেমন ঘটাকাশ,
মঠাকাশ ইত্যাদি মহাকাশের অংশ। ঘটের বা মঠের মধ্যে যে আকাশ আছে তাহাকে মহাকাশের অংশ
বলা যায়, ঘট বা মঠ ভাঙ্গিলে এক অপরিচ্ছিন্ন আকাশই থাকে। জীবেরও দেহোপাধিবশতঃ
ব্রহ্ম হইতে পার্থক্য, দেহোপাধিনাশে এক অপরিচ্ছিন্ন ব্রহ্মসত্ত্বাই অবশিষ্ট থাকে (‘ব্রহ্মাদ্বয়ং
শিষ্যতে’)।
অপর পক্ষে কেহ কেহ বলেন – ‘জীব ও ঈশ্বর উভয়ই
চিদ্রুপ – চেতন, এই
নিমিত্ত অর্থাৎ জীব ও ব্রহ্মের চেতনাংশের সাদৃশ্যেই উভয়ের একত্ব। কিন্তু তাহা
হইলেও জিব, ব্রহ্মের রশ্মি-পরমাণু স্থানীয়; যেমন তেজোময় সূর্য্য হইতে অনন্ত রশ্মি
বহির্গত হয়, অথবা অগ্নিপিণ্ড হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গসমূহ নির্গত হয়, সেইরূপে ব্রহ্ম
হইতে জীবসমূহের উৎপত্তি (‘যথা সুদীপ্তাৎ পাপকাদ্বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে সরূপাঃ’ ইত্যাদি মুণ্ডক।
অগ্নি ভিন্ন স্ফুলিঙ্গের পৃথক্ অস্তিত্ব নাই, ব্রহ্ম ভিন্নও জীবের পৃথক্ সত্ত্বা
নাই। স্ফুলিঙ্গ অগ্নিই বটে, কিন্তু ঠিক অগ্নিও নয়, অগ্নি-কণা। জীব ও ব্রহ্মেও
সেইরূপ অভেদ ও ভেদ আছে, জিব ব্রহ্মকণা। ইহাই গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের ‘অচিন্ত্য
ভেদাভেদবাদ’।
শ্রীমৎ শংকারাচার্য্য
কতকটা এইরূপ ভাবেই জীবব্রহ্মের ভেদাভেদের রহস্য ব্যাখ্যা করিয়াছেন – ‘চৈতন্যঞ্চাবশিষ্টং
জীবেশ্বরয়োর্যথাগ্নি-বিস্ফুলিঙ্গ-য়োরৌষ্ণ্যম্’। “অতো
ভেদাভেদাগমাভ্যামংশত্বাব-গমঃ”
– জীব ব্রহ্মের চৈতন্যাংশে কোন বৈশিষ্ট্য না থাকিলেও, যেমন
অগ্নি-স্ফুলিঙ্গের উষ্ণতাংশে ভেদ প্রতীত হয়, এইরূপ ভেদাভেদ বোধ হওয়ার অংশের অবগতি
হইয়া থাকে।’
বস্তুতঃ অংশ ও অংশীতে স্বরূপতঃ
কোন ভেদ হইতে পারে না। যতক্ষণ আমিত্বের উপাধি ততক্ষণই ভেদ। মুক্তিই অভেদ। কিন্তু
ভক্ত মুক্তি চান না, ‘আমি’টা ত্যাগ করিতে
চান না, তিনি বলেন – ‘চিনি হওয়া ভাল নয়
মন, চিনি খেতে ভালবাসি’, - তাই তিনি অভেদও মান্য করেন না। তাই ভক্তিশাস্ত্র বলেন – জীব কৃষ্ণের
নিত্যদাস।
শরীরং যদবাপ্নোতি যচ্চাপ্যুৎক্রামতীশ্বরঃ।
গৃহীত্বৈতানি সংযাতি বায়ুর্গন্ধানিবাশয়াৎ।।৮
অর্থঃ- (৮) যেমন বায়ু পুস্পাদি
হইতে গন্ধবিশিষ্ট সূক্ষ্ম কণাসমূহ লইয়া যায়, তদ্রুপ জীব যখন এক দেহ পরিত্যাগ করিয়া
অন্য দেহে প্রবেশ করেন, তখন এই সকলকে (এই পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মনকে সঙ্গে করিয়া লইয়া
যান।
শ্রোত্রং চক্ষুঃ স্পর্শনঞ্চ রসনং ঘ্রাণমেবচ।
অধিষ্ঠায় মনশ্চায়ং বিষয়ানুপসেবতে।।৯
অর্থঃ- (৯) জীবাত্মা কর্ণ, চক্ষু, ত্বক্,
নাসিকা এবং মনকে আশ্রয় করিয়া শব্দাদি বিষয়সকল ভোগ করিয়া থাকেন।
জন্মান্তর-রহস্য – জীবের উৎক্রান্তি সূক্ষ্মশরীরঃ
প্রশ্নঃ আত্মা অকর্ত্তা,
উদাসীন, নিত্যযুক্ত। প্রকৃত বা দেহ-বন্ধন বশতঃই তিনিবদ্ধ হন। মৃত্যুর পর যখন সেই
দেহবন্ধন চলিয়া যায়, তখনই ত তিনি মুক্ত হইয়া স্ব-স্বরূপ লাভ করিতে পারেন? তখন আর
প্রকৃতি থাকে কোথায়? দ্বিতীয়তঃ, জীব একদেহে পাপপুণ্যাদি সঞ্চয় করে, জন্মান্তরে
অন্য দেহে তাহার ফল ভোগ করে, এই বা কিরূপ ব্যবস্থা?
উঃ- মৃত্যুর পর জীবের দেহবন্ধনও ঘোচে না, অন্য
দেহেও পাপপুণ্যাদি ফলভোগ হয় না, এই দেহই থাকে। দেহ দুইটি – (১) স্থূল শরীর, আর (২) সূক্ষ্ম শরীর
বা লিঙ্গ শরীর। চর্ম্মচক্ষুতে স্থূল শরীরই দেখা যায়, সূকশম শরীর দেখিতে জ্ঞানচক্ষু
চাই। তাই শ্রীভগবান্ বলিয়াছেন সূক্ষ্ম শরীর লইয়া জীব কিরূপে যাতায়াত করে এবং পাপপুণ্যাদির ফলভোগ করে তাহা অজ্ঞ লোক দেখিতে পায় না, উহা
জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে দর্শন করিয়া থাকেন।
এই দৃশ্য স্থূল শরীর ও
অদৃশ্য সূক্ষ্ম শরীর কোন্টি কিসের দ্বারা গঠিত? –
পূর্ব্বে বলা হইয়াছে,
সাংখ্যোক্ত ২৪ তত্ত্ব (প্রকৃত, মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, ইন্দ্রিয়াদি) দ্বারা এই দেহ
গঠিত। তন্মধ্যে ক্ষিতি, অপ্, প্রভৃতি পাঁচটি স্থূল পদার্থ, বাকী মহত্তত্ত্ব হইতে
পঞ্চতন্মাত্র পর্য্যন্ত ১৮ টি সূক্ষ্ম পদার্থ এবং প্রকৃতি সকলের নির্ব্বিশেষ
কারণ-স্বরূপ সূক্ষ্মানুসূক্ষ্ম পদার্থ। ক্ষিত্যাদি পঞ্চ স্থূলভূতদ্বারা নির্ম্মিত
যে দেহ তাহাই স্থূল শরীর; মহত্তত্ত্ব, অহঙ্কার, দশেন্দ্রিয়, মন ও
পঞ্চতন্মাত্র, এই ১৮টি দ্বারা গঠিত দেহ সূক্ষ্ম শরীর, আর সকলের মূল কারণ প্রকৃতিকেই
কারণ-শরীর কহে মৃত্যুকালে পঞ্চভূতাত্মক স্থূল শরীরই বিনষ্ট হয়, সূক্ষ্মশরীর লইয়া জীব
উৎক্রমণ করে এবং পূর্ব্ব কর্মানুযায়ী নূতন স্থূল-দেহ ধারণ করিয়া ঐ সূক্ষ্ম শরীর লইয়াই
পাপপুণ্যাদি ফলভোগ করে এবং এই কারণেই উহার মন, বুদ্ধি, ধর্ম্মাধর্ম্মাদি সংস্কার অর্থাৎ
স্বভাব পূর্ব্বজন্মানুযায়ীই হয়; তবে জন্মগ্রহণ কালে পিতামাতার দেহ হইতে লিঙ্গ-শরীর
যে দ্রব্য আকর্ষণ করিয়া লয় তাহাতে তাহার দেহ-স্বভাবের ন্যূনাধিক ভাবান্তর ঘটিয়া থাকে।
সুতরাং কেবল স্থূলদেহের সংসর্গ লোপ হইলেই মুক্তি হয় না, সূক্ষ্মশরীরও যখন লোপ পায়,
তখনই জীবের সত্যস্বরূপ প্রতিভাত হয়।
এস্থলে পঞ্চ ইন্দ্রিয় ও মন এই ছয়টিকেই সূক্ষ্মশরীর
বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে; ‘ঘ্রাণমেবচ’ এবং ‘মনশ্চ’
এই দুই পদের চ-কার দ্বারা বুঝাইতেছে যে, উহার মধ্যেই পঞ্চতন্মাত্র, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়,
বুদ্ধি ও অহঙ্কারেরও সমাবেশ করিতে হইবে। দ্রষ্টব্য এই, ‘ইন্দ্রিয়’ বলিতে চক্ষুকর্ণাদি স্থূল ইন্দ্রিয়যন্ত্র
বুঝায় না, উহা স্থূলদেহের অন্তর্গত, প্রকৃত ইন্দ্রিয় বা ইন্দ্রিয়-শক্তি সূক্ষ্ম তত্ত্ব।
ইহাই সাংখ্যোক্ত সূক্ষ্মশরীর। বেদান্ত মতে পঞ্চ
কর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়, পঞ্চ প্রাণ এবং বুদ্ধি ও মন এই সপ্তদশ অবয়বে সূক্ষ্মশরীর
গঠিত। সাংখ্যমতে পঞ্চ প্রাণ একাদশ ইন্দ্রিয়েরই অন্তর্ভূত। আত্মার এই বিভিন্ন আবরণ বা
শরীরকে কোষও বলা হয়। কোষ পাঁচটি –
(১) অন্নময় কোষ; ইহাই পঞ্চভূতাত্মক স্থূল শরীর; (২) মনোময় কোষ (মন ও পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়);
(৩) প্রাণময় কোষ (প্রাণ ও পঞ্চ কর্ম্মেন্দ্রিয়); (৪) বিজ্ঞানময়
কোষ (বুদ্ধি ও পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয়) – এই তিনটি মিলিয়া
সূক্ষ্ম শরীর; (৫) আনন্দময় কোষ, ইহাকেই কারণ-শরীর বলে।
মহাভারতে উল্লেখ আছে, যম
সত্যবানের শরীর হইতে এক অঙ্গুষ্ঠ পরিমিত পুরুষকে আকর্ষণ করিয়া লইয়া চলিলেন (‘অঙ্গুষ্ঠমাত্র-পুরুষং
নিশ্চকর্ষ যমো বলাৎ’)। ইহাই সূক্ষ্মশরীর। যোগিগণ সূক্ষ্মদেহ লইয়া স্থূলদেহ হইতে বহির্গত হইয়া
অন্য শরীরে প্রবেশ করিতে পারেন (মহাভারতে জনক-সুলভা সংবাদ ইত্যাদি দ্রষ্টব্য)।
উৎক্রামন্তং স্থিতং বাপি ভূঞ্জানং বাঁ গুণান্বিতম্।
বিমূঢ়া নানুপশ্যন্তি পশ্যন্তি জ্ঞানচক্ষুষঃ।।১০
অর্থঃ- (১০) জীব কিরূপে সত্ত্বাদি
গুণসংযুক্ত হইয়া দেহে অবস্থিত থাকিয়া বিষয়সমূহ ভোগ করেন অথবা কিরূপে দেহ হইতে
উৎক্রান্ত হন, তাহা অজ্ঞ ব্যক্তিগণ দেখিতে পান না, কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে
দর্শন করিয়া থাকেন।
যতন্তো যোগিনশ্চৈনং পশ্যন্ত্যাত্মন্যবস্থিতম্।
যতন্তোহপ্যকৃতাত্মানো নৈনং পশ্যন্ত্যচেতসঃ।।১১
অর্থঃ- (১১) সাধনে যত্নশীল যোগিগণ আপনাতে
অবস্থিত এই আত্মাকে দর্শন করিয়া থাকেন, কিন্তু যাহারা অজিতেন্দ্রিয় ও অবিবেকী
তাহারা যত্ন করিলেও ইহাকে দেখিতে পায় না।
দেহস্থিত জীব কিরূপে
ত্রিগুণের দ্বারা বদ্ধ হইয়া বিষয় ভোগ করেন, অথবা কিরূপে এক দেহ হইতে বহির্গত হইয়া
দেহান্তরে প্রবেশ করেন, এই জীব কে, তাহার প্রকৃত স্বরূপ কি – এই সকল তত্ত্ব
দুর্জ্ঞেয়। কেবল শাস্ত্রাভ্যাসে আত্ম-দর্শম হয় না, যাঁহারা ইন্দ্রিয় জয় করিয়া
যোগযুক্ত চিত্তে সাধনা করেন, তাঁহারাই আত্মাকে দর্শন করিতে পারেন। আবিবেকিগণ
শাস্ত্রাদি প্রমাণ অবলম্বনে চেস্টহা করিলেও আত্মতত্ত্ব বুঝিতে পারে না। ইহাই
পূর্ব্বোক্ত দুই শ্লোকের তাৎপর্য্য।
যদাদিত্যগতং তেজো জগত্ ভাসয়তেহখিলম্।
যচ্চন্দ্রমসি যচ্চাগ্নৌ তৎ তেজো বিদ্ধি মামকম্।।১২
অর্থঃ- (১২) যে তেজ সূর্য্যে থাকিয়া সমগ্র জগৎ উদ্ভাসিত করে, এবং যে তেজ চন্দ্রমা
ও অগ্নিতে আছে, তাহা আমারই তেজ জানিবে।
এই কয়েকটি শ্লোকে পরমেশ্বরের বিশ্বানুগতা পুনরায় বর্ননা
করে হইয়াছে।
গামাবিশ্য চ ভূতানি ধারয়াম্যহমোজসা।
পুষ্ণামি চৌষধীঃ সর্ব্বাঃ সোমো ভূত্বা রসাত্মকঃ।১৩
অর্থঃ- (১৩) আমি পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া
স্বকীয় বলের দ্বারা ভূতগণকে ধারণ করিয়া আছি। আমি অমৃত রসযুক্ত চন্ররূপ ধারণ করিয়া
ব্রীহি যবাদি ওষধিগণকে পরিপুষ্ট করিয়া থাকি।
শাস্ত্রে এইরূপ বর্ণনা
আছে যে, চন্দ্র জলময় ও সর্ব্বরসের আধার এবং চন্দ্রের এই রসাত্মক গুণেই বনস্পতিগণ
বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
অহং বৈশ্বানরো ভূত্বা প্রাণিনাং দেহমাশ্রিতঃ।
প্রাণাপানসমাযুক্তঃ পচাম্যন্নং চতুর্ব্বিধম্।।১৪
চতুর্ব্বিধম্ অন্নং – চর্ব্য, চোষ্য, লেহ্য,
পেয় এই চতুর্ব্বিধ খাদ্য।
অর্থঃ- (১৪) আমি বৈশ্বানর (জঠরাগ্নি) রূপে
প্রাণিগণের দেহে অবস্থান করি এবং প্রাণ ও অপান বায়ুর সহিত মিলিত হইয়া চর্ব্ব্য
চোষ্যাদি চতুর্ব্বিধ খাদ্য পরিপাক করি।
দেহযন্ত্রে একখণ্ড রুটি
ফেলিয়া দিলে উহা রক্তে পরিণত হয়। চেহাভ্যন্তরীণ কি কি প্রক্রিয়ার দ্বারা এই পরিপাক
ক্রিয়া সাধিত হয় তাহা জড়বিজ্ঞান বলিতে পারে। কিন্তু কোন্ শক্তিবলে এই কার্য্য সম্পন্ন
হয়, তাহা জড়বিজ্ঞান জানে না। উহা ঐশ্বরিক শক্তি।
সর্ব্বস্য চাহং হ্রদি সন্নিবিষ্টো মত্তঃ স্মৃতির্জ্ঞানমপোহনঞ্চ।
বেদৈশ্চ সর্ব্বৈরহমেব বেদ্যো বেদান্তকৃদ্ বেদবিদেব চাহম্।।১৫
অর্থঃ- (১৫) আমি অন্তর্যামিরূপে সকল প্রাণীর
হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছি, আমা হইতেই প্রাণগনের স্মৃতি ও জ্ঞান উৎপন্ন হইয়া থাকে এবং আমা
হইতেই স্মৃতি ও জ্ঞানের বিলোপও সম্পাদিত হয়, আমিই দেবসমূহের একমাত্র জ্ঞাতব্য,
আমিই আচার্য্যরূপে বেদান্তের অর্থ প্রকাশক এবং আমিই বুদ্ধিতে অধিষ্ঠিত থাকিয়া
বেদার্থ পরিজ্ঞান হই।
আত্মবৈতন্য প্রভাবে জীবের
স্মৃতি ও জ্ঞানের উদয় হইয়া থাকে এবং যে মোহবশতঃ স্মৃতি ও জ্ঞানের লোপ হয়, সেই মোহও
তাহা হইতেই জাত। সমস্ত বেদেই তাহাকে জানিতে উপদেশ করেন। দেবব্যাসাদিররূপে তিনিই
বেদার্থ প্রকাশক এবং বেদবেত্তা বা ব্রহ্মবেত্তাও তিনিই, ব্রহ্ম না হইলে ব্রহ্মকে
জানা যায় না।
দ্বাবিমৌ পুরুষৌ লোকে ক্ষরশ্চাক্ষর এব চ।
ক্ষরঃ সর্ব্বাণি ভূতানি কূটস্থোহক্ষর উচ্যতে।।১৬
অর্থঃ- (১৬) ক্ষর ও অক্ষর, এই দুই পুরুষ এই
লোকে প্রসিদ্ধ আছে। তন্মধ্যে সর্বভূত ক্ষর পুরুষ এবং কুটস্থ অক্ষর পুরুষ বলিয়া
কথিত হন।
উত্তমঃ পুরুষস্ত্বন্যঃ
পরমাত্মেত্যুদাহৃতঃ।
যো লোকত্রয়মাবিশ্য বিভর্ত্ত্যব্যয় ঈশ্বরঃ।।১৭
অর্থঃ- (১৭) অন্য এক উত্তম পরমাত্মা বলিয়া কথিত হয়। তিনি লোকত্রয়ে প্রবিষ্ট হইয়া
সকলকে পালন করিতেছেন, তিনি অব্যয়, তিনি ঈশ্বর।
যস্মাৎ ক্ষরমতীহহমক্ষরাদপি চোত্তমঃ।
অতোহস্মি লোকে বেদে চ প্রথিতঃ পুরুষোত্তমঃ।।১৮
অর্থঃ- (১৮) যেহেতু আমি ক্ষরের অতীত এবং
অক্ষর হইতেও উত্তম, সেই হেতু আমি লোক-ব্যবহারে এবং বেদে, পুরুষোত্তম বলিয়া খ্যাত।
পুরুষোত্তম-তত্ত্বঃ
এস্থলে তিনটি পুরুষের কথা বলা হইতেছে – ক্ষর পুরুষ, অক্ষর পুরুষ ও উত্তম পুরুষ বা
পুরুষোত্তম। ইহার কোন্টিতে কোন্ তত্ত্ব প্রকাশ করে?
শ্রীভগবান্ বলিতেছেন – ক্ষর পুরুষ সর্ব্বভূত, অক্ষর কুটস্থ পুরুষ এবং আমি ক্ষরের অতীত এবং অক্ষর
হইতেও উত্তম, এই হেতু আমি পুরুষোত্তম।
সাধারণতঃ কুটস্থ অক্ষর বলিতে নির্গুণ নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্বই বুঝায়।
গীতায়ও অনেক স্থলেই এই অর্থেই কুটস্থ ও অক্ষর শব্দ ব্যবহৃত হইয়াছে। এস্থলে কিন্তু বলা হইতেছে, আমি অক্ষর হইতেও
উত্তম। উপনিষদে এবং ব্রহ্মসূত্রে ব্রহ্মই অদ্বয় পরতত্ত্ব। ব্রহ্মস্বরূপ কোথায়ও
নির্গুণ, কোথায়ও সগুণ, কোথায়ও সগুণ-নির্গুণ উভয়রূপেই বর্ণনা করা হইয়াছে।
শ্বেতাশ্বতর প্রভৃতি কোন কোন উপনিষদে, মূল তত্ত্বের বর্ণনায় দেব, ঈশ্বর, পুরুষ
প্রভৃতি শব্দও ব্যবহৃত হইয়াছে। ভাগবতশাস্ত্রে উপনিষদের এই দেব, ঈশ্বর বা সগুণ
ব্রহ্মই পুরুষোত্তম বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব অপেক্ষা ইহাকে
শ্রেষ্ঠস্থান দেওয়া হইয়াছে; কেননা ভক্তিমার্গে অনির্দ্দেশ্য, অচিন্ত্য নির্গুণ
তত্ত্বের বিশেষ উপযোগিতা নাই। মহাভারতের নারায়ণীয় পর্ব্বাধ্যায়ে (যাহা ভাগবত
শাস্ত্রের বা সাত্ত্বত ধর্ম্মের মূল) এই পুরুষোত্তম শব্দ পুনঃ পুনঃ ব্যবহৃত হইয়াছে
এবং তিনি নির্গুণ হইয়াও গুণধারক, তিনিই অব্যয়, পরমাত্মা, পরমেশ্বর, ইহা স্পষ্টই
বলা হইয়াছে। পুরাণাদিতে ভগবান্ পুরুষোত্তমই পরতত্ত্ব ও পরব্রহ্ম বলিয়া কীর্ত্তিত
এবং অনেক স্থানেই তাঁহার নির্ব্বিশেষ নির্গুণ স্বরূপ অপেক্ষা সবিশেষ সগুণ বিভাবেরই
বৈশিষ্ট্য বর্ণিত হইয়াছে। গীতাও ভাগবত ধর্ম্মেরই গ্রন্থ, উহাতে পুরুষোত্তম বা
গভবত্ত্বই পরমেশ্বরের শ্রেষ্ঠ স্বরূপ বলিয়া বর্ণিত হইয়াছেন এবং উহাতেই
ব্রহ্মতত্ত্বের প্রতিষ্ঠা, এরূপ বর্ণনাও আছে।
মোট কথা, ‘ব্রহ্মই সমস্ত’ (সর্বং খল্বিদংব্রহ্ম) এই বৈদান্তিক মূলতত্ত্বই
গীতার প্রতিপাদ্য। পূর্ব্বোক্ত তিনি পুরুষ সেই মূল তত্ত্বেরই বিশ্লেষণ। ঐ তিন
পুরুষ এক তত্ত্বেরই তিন বিভাব। এই পরিণামী চেতনাচেতনাত্মক জগৎ (সর্ব্বভূতানি) তাহা
হইতেই জলবুদ্বুদের ন্যায় উত্থিত হইয়া আবার তাঁহাতেই বিলীন হয়। তাঁহার অপরা ও পরা
প্রকৃত সংযোগে উহা সৃষ্ট এবং তাঁহার জীবভূতা পরা প্রকৃতিই উহা ধারণ করিয়া আছে।
ইহাই ক্ষরভাব এবং তাঁহার অপরিণামী নির্ব্বিশেষি কুটস্থ নির্গুণ স্বরূপই অক্ষর
পুরুষ বা অক্ষর ভাব, আর পুরুষোত্তম ভাবে তিনি নির্গুণ হইয়াও সগুণ,
সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়কর্ত্তা, যজ্ঞতপস্যার ভোক্তা, সর্ব্বভূতের ‘গতিকর্ত্তা প্রভুঃ সাক্ষী নিবাসঃ শরণং সুহৃৎ।
গীতার মতে, ইহাই তাঁহার শ্রেষ্ঠ ‘সমগ্র স্বরূপ’।
শ্রীঅরবিন্দ এই তিনটি
তত্ত্ব এইরূপ ভাবে ব্যাখ্যা করিয়াছেন –
"ক্ষর হইতেছে সচল,
পরিণামী – আত্মার বহুভূত বহু-রূপে যে পরিণাম তাহাকেই ক্ষর পুরুষ বলা হইতেছে। এখানে
পুরুষ বলিতে ভগবানের বহুরূপ (Multiplicity of the Divine Being)
বুঝাইতেছে – এই পুরুষ
প্রকৃতি হইতে স্বতন্ত্র নহে, ইহা প্রকৃতিরই অন্তর্গত। অক্ষর হইতেছে অচল, অপরিণামী,
নীরব, নিস্ক্রিয় পুরুষ – ইহা ভগবানের একরূপ (the Unity of the Divine Being), প্রকৃতির
সাক্ষী; কিন্তু প্রকৃতি ও তাহার কার্য্য হইতে এই পুরুষ মুক্ত। পরমেশ্বর, পরব্রহ্ম,
পরম পুরুষই উত্তম, উল্লিখিত পরিণামী বহুত্ব ও অপরিণামী একত্ব এই দুই-ই উত্তমের।
তাঁহার প্রকৃতির, তাঁহার শক্তির বিরাট ক্রিয়ার বলে, তাঁহার ইচ্ছা ও প্রভাবের বশেই
তিনি নিজকে সংসারে ব্যক্ত করিয়াছেন। আবার আরও মহান, নীরবতা ও অচলতার দ্বারা নিজকে
স্বতন্ত্র, নির্লিপ্ত রাখিয়াছেন; তথাপি তিনি পুরুষোত্তমরূপে প্রকৃতি হইতে
স্বতন্ত্রতা এবং প্রকৃতিতে নির্লিপ্ততা এই দুইয়েরই উপরে। পুরুষোত্তম সন্বন্ধে
এইরূপ ধারণা উপনিষদে প্রায়ই সূচিত হইলেও গীতাতেই ইহা স্পস্টভাবে বর্ণিত হইয়াছে এবং
তাহার পর হইতে ভারতীয় ধর্মচিন্তার উপর এই ধারণা বিশেষ প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। যে
সর্ব্বোত্তম ভক্তিযোগ অত্বৈতবাদে কঠিন নিগড় ছাড়াইয়া যাইতে চায়, ইহাই (অর্থাৎ এই
পুরুষোত্তমতত্ত্ব) তাহার ভিত্তি; ভক্তিরসাত্মক পুরাণ-সমূহের মূলে এই পুরুষত্তম-বাদ
নিহিত রহিয়াছে।"
এই পুরুষোত্তমবাদ
দ্বারাই গীতা, জ্ঞান, কর্ম্ম ও ভক্তির সমস্বয় সাধন করিয়াছেন। ব্রহ্মবাদে উহা হয়
না, কেননা মায়াবাদিগণের ব্রহ্ম নীরব, অক্ষর, নিস্ক্রিয়; সাংখ্যদিগের পুরুষও
তদ্রূপ; সুতরাং আ উভয় মতেই কর্ম্মত্যাগ ভিন্ন মোক্ষলাভের অন্য উপায় নাই এবং এই
মোক্ষ বা মিলনে ভক্তিরও স্থান নাই। কিন্তু গীতার পুরুষোত্তম যেমন সম, শান্ত,
নির্গুণ, অনন্ত, অখিলাত্মা, আবার তিনিই গুণ-পালকি, গুণ-ধারক, নির্গুণ, অনন্ত,
অখিলাত্মা, আবার তিনিই গুণ-পালক, গুণ-ধারক, প্রকৃত বা কর্মের প্রেরয়িতা,
যজ্ঞ-তপস্যার ভোক্তা, সর্ব্বলোকমহেশ্বর। সুতরাং সর্ব্বভূতাত্মৈক্য জ্ঞানই
পুরুষোত্তমের জ্ঞান, সর্ব্বভূতে প্রীতি ও সেই সর্ব্বশরণে আত্মসমর্পণই পুরুষোত্তমে ভক্ত
এবং সর্ব্বলোকসংগ্রাহার্থ নিস্কাম কর্ম্ম পুরুষোত্তমেরই কর্ম্ম (‘মৎকর্ম্মকৃৎ’) – এইরূপ জ্ঞান,
ভক্তি ও কর্ম্মের মিলনের দ্বারা আত্মা সর্ব্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়,
- যিনি একই কালে অনন্ত আধ্যাত্মিক শানিত এবং অনন্ত বিশ্বব্যাপী কর্ম্ম উভয়েরই
অধীশ্বর সেই পুরুষোত্তমের মধ্যে বাস করেন (‘স যোগী ময়ি বর্ত্ততে’ ‘বিশতে তদনন্তরম্’)। ইহাই গীতার
গুহ্য সারতত্ত্ব (‘গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদং’)। ইহাই ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণোক্ত ভাগবত ধর্ম্ম, ইহার অন্তর্নিবিষ্ট
সার্ব্বভৌম দার্শনিক তত্ত্ব ও ধর্ম্মনীতি জাতিধর্ম্মনির্ব্বিশেষে মানবমাত্রেরই
অধিগম্য। এরূপ উদার সর্ব্বতঃপূর্ণ সর্ব্বাঙ্গসুন্দর ধর্মতত্ত্ব জগতে আর কোথাও
প্রচলিত্য হয় নাই।
কিন্তু সকলে গীতার এই
বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেন না, বা স্বীকার করেন না। সুতরাং এই শ্লোকের ব্যাখ্যায় বহু
সাম্প্রদায়িক মতভেদ আছে। কেহ বলেন, এস্থলে অক্ষর বলিতে বুঝায় অব্যক্ত প্রকৃতি বা
মায়া, আর ক্ষর বলিতে বুঝায় ব্যক্ত জগৎ। আর ব্যক্ত সৃষ্টি ও অব্যক্ত প্রকৃতির অতীত
যেব্রহ্ম তিনিই পুরুষোত্তম। কেহ বলেন, - এখানে ক্ষর বলিতে বুঝায় প্রকৃতি এবং অক্ষর
বলিতে বুঝায় পুরুষ বা জীবাত্মা এবং উভয়ের অতীত পরব্রহ্মই পুরুষোত্তম। এইমতে
শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের ১।৮, ১০ মন্তের ‘ক্ষর’ ও অক্ষর’ শব্দের অর্থ
ইহাই, কিন্তু উহার পূর্ব্বোক্তরূপ ব্যাখ্যাও হয়। কেহ আবার বলেন, ‘অবিদ্যার
বহুমূর্ত্তিতে অবস্থিত যে চৈতন্য তিনিই ক্ষর জীব, মায়ার এক মূর্ত্তিতে অবস্থিত যে
চৈতন্য তিনি অক্ষর ঈশ্বর এবং মায়াতীত যিনি তিনি পরব্রহ্ম পুরুষোত্তম’। এই যে অবিদ্যা
ও মায়ার পার্থক্য এবং মায়াতীত ব্রহ্ম হইতে মায়াধীশ ঈশ্বরের গৌণত্ব ইহা
পরবর্ত্তীকালীন অদ্বৈত বেদান্তীদিগের একটি মত। গীতায় ‘মায়া’ ও ‘ঈশ্বর’ শব্দ ঠিক এ অর্থে কোথাও
ব্যবহৃত হয় নাই। এই স্থলেই যাহাকে অক্ষর হইতেও উত্তম বলা হইতেছে তাহাকেই অব্যয়
ঈশ্বর বলা হইয়াছে। বস্তুতঃ এইসকল ব্যাখ্যা গ্রহণ করিলে গীতার বিভিন্ন স্থলের
পূর্ব্বাপর সঙ্গতি রক্ষা হয় না এবং গীতার ভাষায়ও এরূপ ব্যাখ্যা সমর্থন করে না। এই
প্রসঙ্গে এই কয়েকটি কথা বিবেচ্যঃ-
(১) এই স্থলে পূর্ব্বে
বলা হইল যে লোকে ক্ষর ও অক্ষর এই দুই পুরুষ আছে। উহা কি? দ্বিতীয় মুণ্ডকে রূপকের
ভাষায় দুই পুরুষের বর্ণনা আছে – ‘স্বা সুপর্ণা
সযুজা সখায়া সমানং বৃক্ষং পরিযস্বজাতে’ – দুইটি সুন্দর পক্ষী (জীব ও ব্রহ্ম) একই
বৃক্ষে (দেহে) অধিষ্ঠিত আছে, তাহারা পরস্পর সখা। শ্বেতাশ্বতরে এই তত্ত্ব লক্ষ্য করিয়াই
বলা হইয়াছে, "জ্ঞাজ্ঞৌ দ্বৌ ঈশানীশৌ" – একজন অজ্ঞ, একজন প্রাজ্ঞ, একজন অনীশ,
একজন ইশ। এই উপনিষদেই অন্যত্র একটি ত্রিবর্ণা অজা (ত্রিগুণা প্রকৃতি) ও দুইটি অজ পুরুষের
(জীব ও ব্রহ্ম) কথা আছে। মহাভারতেও চারিটি অধ্যায়ে ক্ষরাক্ষরের
সুদীর্ঘ বিচার আছে। তথায় অক্ষর বলিতে অপরিণামী নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব এবং ক্ষর
পরিণামী, প্রকৃতি-জড়িত জীবতত্ত্বই বুঝান হইয়াছে। সুতরাং দেখা যায়, জীব বা
প্রকৃতিকে অক্ষর পুরুষ কোথায়ও বলা হয় নাই। গীতায়ও ‘অক্ষর’ ও ‘কুটস্থ’, সর্ব্বত্রই
ব্রহ্মবস্তু বুঝাইতেই ব্যবহৃত হইয়াছে।
(২) এস্থলে বলা হইতেছে, ‘অক্ষর হইতেও (অপি) আমি
উত্তম।’ প্রকৃতি হইতে পরমেশ্বর উত্তম,
- একথা বলিতে ‘অপি’র প্রয়োজন হয় না, উহা সর্ব্ববাদিসম্মত। কিন্তু যাহাকে পরতত্ত্ব, অক্ষর
ব্রহ্ম বলা হয়, তাহা হইতেও উত্তম এই বৈশিষ্ট্য প্রকাশার্থ ‘অপি’ ব্যবহৃত হইয়াছে। নচেৎ ‘অপি’র কোন অর্থ হয় না।
(৩) পরে বলা হইতেছে যে,
ইহা অতি গুহ্যতম শাস্ত্র। 'যে আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানে, সে আমাকে সর্ব্বভাবে
ভজনা করে, ইত্যাদি।'পরব্রহ্ম প্রকৃতি হইতে উত্তম বা নশ্বর জগৎ
প্রপঞ্চের অতীত, ইহাই যদি এস্থলে বলার উদ্দেশ্য হয়, তবে এ তত্ত্ব এমন গুহ্যতম হইল
কিসে? আর আমাকে 'সর্ব্বতোভাবে ভজনা করে', অদ্বৈত ব্রহ্মতত্ত্বে একথারই বা সার্থকতা
কি? প্রকৃত কথা হইতেছে এই, উপনিষদের ব্রহ্মবাদ পূর্ব্বাবধিই সুপ্রচলিত ছিল, উহার সহিত
নিস্কাম কর্ম্ম ও ভক্তির সংযোগ করিয়া যে ভাগবত ধর্ম্মের প্রচার হয়, তাহাতে পুরুষোত্তমই
উপনিষদের ব্রহ্মের স্থান অধিকার করেন। এই ধর্ম্ম পূর্ব্বে
অনেকবার প্রাদুর্ভূত হইয়াও অন্তর্হিত হইয়াছে এবং এই ধর্ম্মই শ্রীভগবান্
অর্জ্জুনকে বলিতেছেন, একথা গীতার চতুর্থ অধ্যায়ে এবং মহাভরতের অন্যত্রও স্পস্টতঃ
আছে এবং ভাগবতেও 'ইহাকে মদ্ধর্ম্ম' বলিয়া উল্লেখ করিয়া
'তুমি ইহা অভক্তকে বলিবে না', শ্রীভগবান্ ভক্ত উদ্ধবকে এইরূপ উপদেশ দিয়াছেন। মহাভারতীয়
নারায়ণীয় পর্ব্বাধ্যায়ে এই পুরুষোত্তম তত্ত্ব ও ভাগবত ধর্ম্মের বিস্তারিত বর্ণনা আছে।
তথায়ও ইহাকে 'সর্ব্ব-শাস্ত্রের শ্রেষ্ঠ', 'উত্তম রহস্য' ('শাস্ত্রাণাং
শাস্ত্রমুত্তমম্', 'রহস্যঞ্চৈতদুত্তমম্' –
শাং), 'অভক্তকে অদেয়' ('নাবাসুদেবভক্তায় ত্বয়া দেয়ং কথঞ্চন') ইত্যাদি বলা হইয়াছে। এস্থলেও
সেই মহাভারতীয় পুরুষোত্তম তত্ত্বই বর্ণিত হইয়াছে এবং ইহাকেই
নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব হইতেও উত্তম বলা হইয়াছে। পুরুষোত্তম পরব্রহ্মই বটেন, কিন্তু
উপনিষদের ব্রহ্মতত্ত্বে অবতারবাদ ও ভক্তির প্রসঙ্গ নাই। ভাগবতধর্ম্মে ঐ দুইটির
প্রাধান্য থাকাতেই পুরুষোত্তম তত্ত্বের বৈশিষ্ট্য জন্মিয়াছে। ইহাই 'উত্তম রহস্য'।
(৪) পুরুষোত্তমতত্ত্বের
এই বৈশিষ্ট্য স্বীকার না করিলে গীতার অন্যান্য স্থলেরও অর্থসঙ্গতি হয় না।
শ্রীভগবান্ ১৪।৫৪ শ্লোকে বলিতেছেন, 'ব্রহ্মভাব লাভ করিলে আমাতে
ভক্তি জন্মে এবং ভক্তিদ্বারা তত্ত্বতঃ জানিয়া আমাতে প্রবেশ করা যায়', আবার অন্যত্র
ব্রহ্মনির্ব্বাণ বা আত্মদর্শন লাভ করার পরও ভগবদ্দর্শনের প্রয়োজনীয়াতার উল্লেখ করিতেছেন।
নির্গুণ ব্রহ্মই পরতত্ত্ব এবং ব্রাহ্মী স্থিতিই গীতার শেষ কথা হইলে এই সকল শ্লোকের
কোনও অর্থ হয় না। বস্তুতঃ নির্গুণ-গুণী পুরুষোত্তমই যে পরতত্ত্ব এবং অনির্দ্দেশ্য ব্রহ্মতত্ত্ব
হইতেও উত্তম, এ সকল শ্লোক এই মর্ম্মেরই পরিপোষক।
আবার কেহ কেহ বলেন যে শ্রীগীতার এই শ্লোকগুলি
– যে স্থলে শ্রীভগবান্ আপনাকে
অক্ষর পুরুষ হইতেও উত্তম বা পুরুষোত্তম বলিয়া বর্ণনা করিয়াছেন, - তাহা প্রক্ষিপ্ত।
ইহারা বলেন –
"গীতার পুরুষোত্তমবাদ একটি বৈষ্ণব মত। ইহা
বৈদান্তিক মত নহে। এই অংশকে প্রক্ষিপ্ত বলিলে গীতার মৌলিক মতের কোন ব্যত্যয় ঘটে না,
গীতার অন্য কোন মত এই অংশের উপর নির্ভর করে না। এই অংশ প্রক্ষিপ্ত করিবার উদ্দেস্য
– বৈষ্ণব মত প্রচায়"
– স্বর্গত মহেশচন্দ্র ঘোষ,
প্রবাসী, শ্রাবণ, ১৩৩৫।
ইহা বৈষ্ণব মত এ কথা ঠিক। তবে বৈষ্ণবগণ বলেন,
শ্রীগীতাও বৈষ্ণব গ্রন্থ, ভাগবত ধর্ম্ম বা সাত্ত্বত ধর্ম্মের মূল গ্রন্থ (ভূমিকা দ্রষ্টব্য)।
ইহা কেবল নির্ব্বিশেষ ব্রহ্মতত্ত্ব-প্রতিপাদক বৈদান্তিক গ্রন্থ নহে। ইহা ব্রহ্মবিদ্যার
অন্তর্গত (কর্ম্ম) যোগশাস্ত্র। ব্রহ্মজ্ঞান, নিষ্কাম কর্ম্ম ও ঐকান্তিক ভগবদ্ভক্তির
সমুত্তয় মূলে অপূর্ব্ব যোগধর্ম্মের প্রচারই ইহার বিশেষত্ব। ইহাই ভাগবত ধর্মের প্রাচীন
স্বরূপ এবং এই ধর্ম প্রচারই গীতার উদ্দেশ্য।
কর্ম্ম-জ্ঞান-ভক্তির সমুচ্চয়ই গীতার মূল প্রতিপাদ্য
এ কথা স্বীকার করিলে ইহাও স্বীকার করিতে হয় যে, এই পুরুষোত্তমবাদ বা ঈশ্বরবাদের উপরই
এই সমুচ্চয়বাদ সম্পূর্ণ নির্ভর করে। কারণ, বেদান্তের অনির্দ্দেশ্য, নির্গুণ নিষ্ক্রিয়
ব্রহ্মভাবে কর্ম্ম ও ভক্তির স্থান নাই। এই হেতুই গীতা, ভাগবত প্রভৃতি সাত্ত্বত-ধর্ম্ম
শাস্ত্রে নিষ্ক্রিয় অক্ষর ব্রহ্ম অপেক্ষা ক্রিয়াশীল, 'ভক্তের ভগবান্', 'নির্গুণ-গুণী'
ব্রহ্মের বৈশিষ্ট্য। ইনিই পুরুষোত্তম। সুতরাং গীতার মূল প্রতিপাদ্য বিষয়ের দিকে দৃষ্টি
রাখিলে এ সকল শ্লোক প্রক্ষিপ্ত তো নহেই, বরং বিশেষ প্রয়োজনীয় বলিয়াই বোধ হয়।
মায়াবাদিগণের ব্রহ্ম নীরব, অক্ষর, নিষ্ক্রিয়,
সাংখ্যদের পুরুষও তদ্রূপ। ভগবান্ যদি শুধু এই অক্ষর আত্মা হন এবং তাহা হইতে যে সত্ত্বা
প্রকৃতির খেলায় বাহির হইয়াছে তাহাই যদি জীব হয়, তাহা হইলে যে মুহূর্ত্তে জীব ফিরিয়া
আসিবে ও আত্মায় প্রতিষ্ঠিত হইবে তখনই সমস্ত বদ্ধ হইয়া যাইবে, কেবল থাকিবে পরম ঐক্য,
পরম নিস্তব্ধতা। - তাহা হইলে সর্ব্বাপেক্ষা ভীষণ ও ধ্বংসসঙ্কুল কর্ম্ম করিতে পুনঃ পুনঃ
আদেশ কেন, এই রথ কেন, এই যুদ্ধ কেন, এই যোদ্ধা কেন, এই দিব্য সারথি কেন? গীতা এই বলিয়া
জবাব দিয়াছেন যে, ভগবান্ অক্ষর আত্মা অপেক্ষাও বড়, আরও অধিক ব্যাপক, তিনি একাধারে
অক্ষর ব্রহ্ম বটেন আবার প্রকৃতির কার্য্যের অধীশ্বরও বটেন। - জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম্মের
মিলনের দ্বারা আত্মার সর্ব্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়, যিনি এক কালে অনন্ত
আধ্যাত্মিক শান্তি এবং অনন্ত্য বিশ্বব্যাপী কর্ম্ম উভয়েরই অধীশ্বর সেই পুরুষোত্তমের
মধ্যে বাস করে। ইহাই গীতার সমন্বয় –
অরবিন্দের গীতা।
যো মামেবমসংমূঢ়ো জানাতি পুরুষোত্তমম্।
স সর্ব্ববিদ্ ভজতি মাং সর্ব্বভাবেন ভারত।।১৯
অর্থঃ- (১৯) হে ভারত, যিনি মোহযুক্ত হইয়া এই
ভাবে আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিতে পারেন, তিনি সর্ব্বজ্ঞ হন এবং সর্বতোভাবে আমাকে
ভজনা করেন।
'তিনি সর্ব্বজ্ঞ হন' – অর্থাৎ আমাকে পুরুষোত্তম বলিয়া জানিলে
আর জানিবার কিছু অবশিষ্ট থাকে না, সগুণ-নির্গুণ, সাকার-নিরাকার, দ্বৈতাদ্বৈত ইত্যাদি
সংশয় আর তাহার উপস্থিত হয় না। তিনি জানেন, আমিই নির্গুণ পরব্রহ্ম, আমিই সগুণ বিশ্বরূপ,
আমিই সর্ব্বলোক-মহেশ্বর, 'আমিই লীলার অবতার, আমিই হৃদয়ে পরমাত্মা, সুতরাং তিনি সকল
ভাবেই আমাকে ভজনা করেন।'
ইতি গুহ্যতমং শাস্ত্রমিদমুক্তং ময়ানঘ।
এতদ্ বুদ্ধ বুদ্ধিমান্ স্যাৎ কৃতকৃত্যশ্চ ভারত।।২০
অর্থঃ- (২০) হে নিষ্পাপ, আমি এই অতি গুহ্য কথা
তোমাকে কহিলাম, যে কেহ ইহা জানিলে জ্ঞানী ও কৃতকৃত্য হয়। (অতএব তুমিও যে কৃতার্থ হইবে
তাহাতে সন্দেহ কি?)।
পঞ্চদশ অধ্যায় –
বিশ্লেষণ ও সার-সংক্ষেপ
সংসার-বৃক্ষঃ পুরুষোত্তম তত্ত্ব
পূর্ব্ব অধ্যায়ের শেষে শ্রীভগবান্ বলিয়াছেন
যে, যে আমাকে অনন্যভাবে ভজনা করে, সে ত্রিগুণাতীত হইয়া ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়। ত্রিগুণাতীত
হওয়ার অর্থ সংসারের মায়াপ্রপঞ্চ অতিক্রম করা, ইহাকেই সংসার-ক্ষর বলেন। এই কথাটি আরও
স্পষ্টিকৃত করিবার উদ্দেশ্যেই এই অধ্যায়ে প্রথমতঃ সংসার কি, উহার মূল কোথায়, জীবের
জন্ম ও উৎক্রান্তি কিরূপে হয় –
ইত্যাদি বর্ণনা করিয়া পরিশেষে ভগবান্ পুরুষোত্তমরূপে আত্ম-পরিচয় দিয়া বলিতেছেন যে,
উহাই পরতত্ত্ব এবং তাঁহাকে পুরুষোত্তমরূপে জানিলেই জীব কৃতার্থ হয় ও সর্ব্বতোভাবে তাঁহার
ভজনা করে।
সংসার-বৃক্ষঃ – এই সংসার অশ্বত্থ বৃক্ষস্বরূপ। উহার
প্রধান মূল ঊর্দ্ধদিকে (পরব্রহ্ম); উহার শাখাসমূহ আধোদিকে বিস্তৃত (দেবাদি যোনি ও পশ্বাদি
যোনিতে জীবজন্ম); বেদসমূহ উহার পত্র-স্বরূপ (ধর্মাধর্ম্ম প্রতিপাদন দ্বারা পত্রের ন্যায়
রক্ষক স্বরূপ); শব্দস্পর্শাদি বিষয়সমূহ উহার প্রবাল বা তরুণ পল্লবস্থানীয়; উহার বাসনারূপ
অবান্তর মূলসকল ধর্ম্মাধর্ম্মরূপ কর্ম্মের প্রসূতি। মায়াবদ্ধ জীব ইহার প্রকৃত স্বরূপ
জানে না, বৈরাগ্যরূপ অস্ত্রদ্বারা মায়াবন্ধন ছেদন করিয়া সংসার প্রবৃত্তির আদি কারণ
পরমেশ্বরের পরমপদ অন্বেষণ করা কর্ত্তব্য। অভিমান, আসক্তি, কামনা ও সুখদুঃখাদি দ্বন্দ্ব
হইতে মুক্ত হইলে সেই পরমপদ লাভ হয়। সেই অব্যয় পদ প্রাপ্তি হইলে আর সংসারে প্রত্যাবর্ত্তন
করিতে হয় না।
জীবের জন্মকর্ম্মঃ – শ্রীভগবান্ বলিতেছেন, জীব আমারই সনাতন
অংশ। উহা কর্ম্মফলে সদসদ্যোনিতে জন্মগ্রহণ করিয়া সুখদুঃখাদি ভোগ করেন। উহা দেহত্যাগ
কালে সূক্ষ্ম শরীর লইয়া উৎক্রান্ত হয় এবং স্বকর্ম্মানুযায়ী নূতন স্থূল শরীর ধারণ করিয়া
ঐ সূক্ষ্ম শরীর লইয়াই পুনরায় বিষয়সমূহ ভোগ করিতে থাকে। জীবের এই জন্মকর্ম্মতত্ত্ব অজ্ঞ
ব্যক্তিগণ বুঝিতে পারে না, কিন্তু জ্ঞানিগণ জ্ঞাননেত্রে উহা দর্শন করিয়া থাকেন।
আমিই সর্ব্বকারণের কারণঃ – চন্দ্রসূর্য্যাদি সমস্তই আমার সত্তায়
সত্তাবান্, আমার শক্তিতে শক্তিমান্। আমিই পৃথিবীতে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া ভূতগণকে ধারণ
করিয়া আছি। আমার শক্তিতেই ওষধিসমূহ পরিপুষ্ট হইয়া থাকে। আমি জঠরাগ্নিরূপে দেহ রক্ষা
করি, আমিই অন্তর্য্যামিরূপে সর্ব্বজীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত আছি। আমিই বেদসমূহে একমাত্র
জ্ঞাতব্য, এবং আমিই আচার্য্যরূপে বেদান্তের অর্থ-প্রকাশক।
আমিই পরতত্ত্ব পুরুষোত্তমঃ – লোকে ক্ষর (সর্ব্বভূত, প্রাকৃতি-জড়িত
জীব) ও অক্ষর (কূটস্থ, নির্গুণ ব্রহ্মতত্ত্ব) এই দুই পুরুষ প্রথিত আছে, আমি ক্ষরের
অতীত এবং কূটস্থ হইতেও উত্তম, এই হেতু আমি পুরুষোত্তম বলিয়া খ্যাত। আমাকে পুরুষোত্তমরূপে
জানিলে আর কিছুই জানিবার অবশিষ্ট থাকে না। তখন জীব বুঝিতে পারে যে, আমি নির্গুণ, আমিই
সগুণ, আমিই বিশ্বরূপ, আমিই অবতার, আমিই আত্মা। এই পুরুষোত্তমতত্ত্ব অতি গুহ্য। ইহা
জানিলে জীব কৃতকৃত্য হয়; সে সর্ব্বতোভাবে আমাকে ভজনা করে।
এই অধ্যায়ে প্রধান আলোচনার বিষয় পুরুষোত্তমতত্ত্ব।
এই হেতু ইহাকে পুরুষোত্তমযোগ কহে।
ইতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষৎসু ব্রহ্মবিদ্যায়াং
যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জ্জুন-সংবাদে পুরুষোত্তমযোগো নাম পঞ্চদশোহধ্যায়ঃ।