Popular Posts

Tuesday, August 30, 2011

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : তৃতীয়োহধ্যায় (শ্লোক অর্থসহ)

অর্জ্জুন উবাচ -
জ্যায়সী চেৎ কর্ম্মণস্তে মত্য বুদ্ধির্জনার্দ্দন।
তৎ কিং কর্ম্মণি ঘোরে মাং নিয়োজয়সি কেশব।।১
ব্যামিশ্রেণেব বাক্যেন বুদ্ধিং মোহয়সীব মে।
তদেকং বদ নিশ্চিত্য যেন শ্রেয়োহহমাপ্নুয়াম্।।২


অর্থঃ-(১,২) অর্জ্জুন বলিলেন - হে জনার্দ্দন, যদি তোমার মতে কর্ম্ম হইতে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, তবে হে কেশব, আমাকে হিংসাত্মক কর্ম্মে কেন নিযুক্ত করিতেছ? বিমিশ্র বাক্যদ্বারা কেন আমার মনকে মোহিত করিতেছ; যাহাদ্বারা আমি শ্রেয় লাভ করিতে পারি সেই একটি (পথ) আমাকে নিশ্চিত করিয়া বল।


লোকেহস্মিন্ দ্বিবিধা নিষ্ঠা পুরা প্রোক্তা ময়ানঘ।
জ্ঞানযোগেন সাংখ্যানাং কর্ম্মযোগেন যোগিনাম্।।৩


অর্থঃ-(৩) হে অনঘ, ইহলোকে দ্বিবিধ নিষ্ঠা আছে, ইহা পূর্ব্বে বলিয়াছি।  সাংখ্যদিগের জন্য জ্ঞানযোগ এবং কর্ম্মীদিগের জন্য কর্ম্মযোগ।


ন কর্ম্মণামনারম্ভান্নৈষ্কর্ম্ম্যং পুরুষোহশ্ন তে।
ন চ সংন্যসনাদেব সিদ্ধিং সমধিগচ্ছতি।।৪


অর্থঃ-(৪) কর্মচেষ্টা না করিলেই পুরুষ নৈস্কর্ম্ম্যলাভ করিতে পারে না, আর (কামনা ত্যাগ ব্যতীত) কর্ম্মত্যাগ করিলেই সিদ্ধিলাভ হয় না।


ন হি কশ্চিৎ ক্ষণমপি জাতু তিষ্ঠত্যকর্ম্মকৃৎ।
কার্য্যতে হ্যবশঃ কর্ম্ম সর্ব্বঃ প্রকৃতিজৈর্গুণৈঃ।।৫


অর্থঃ-(৫) কেহই কখনো ক্ষণকাল কর্ম্ম না করিয়া থাকিতে পারে না, কেননা, প্রকৃতির গুণে অবশ হইয়া সকলেই কর্ম্ম করিতে বাধ্য হয়।


কর্ম্মেন্দ্রিয়াণি সংযম্য য আস্তে মনসা স্মরন্।
ইন্দ্রিয়ার্থান্ বিমূঢ়াত্মা মিথ্যাচারঃ স উচ্যতে।।৬


অর্থঃ-(৬) যে ভ্রান্তমতি হস্তপদাদি কর্ম্মেন্দ্রিয় সকল সংযত করিয়া অবশ্তিতি করে, অথচ মনে মনে ইন্দ্রিয়-বিষয়সকল স্মরণ করে, সে মিথ্যাচারী।


যস্ত্বিন্দ্রিয়াণি মনসা নিয়ম্যারভতেহর্জ্জুন।
কর্ম্মেন্দ্রিয়ৈঃ কর্ম্মযোগমসক্তঃ স বিশিষ্যতে।।৭


অর্থঃ-(৭) কিন্তু যিনি মনের দ্বারা জ্ঞানেন্দ্রিয়সকল সংযত করিয়া অনাসক্ত হইয়া কর্ম্মেন্দ্রিয়ের দ্বারা কর্ম্মযোগের আরম্ভ করেন, তিনিই শ্রেষ্ঠ।


নিয়তং কুরু কর্ম্ম ত্বং কর্ম্ম জ্যায়ো হ্যকর্ম্মণঃ।
শরীরযাত্রাপি চ তে ন প্রসিধ্যেদকর্ম্মণঃ।।৮


অর্থঃ-(৮) তুমি নিয়ত কর্ম্ম কর; কর্ম্মশূন্যতা অপেক্ষা কর্ম্ম শ্রেষ্ঠ, কর্ম্ম না করিয়া তোমার দেহযাত্রাও নির্ব্বাহ হইতে পারে না।


যজ্ঞার্থাৎ কর্ম্মণোহন্যত্র লোকোহয়ং কর্ম্মবন্ধনঃ।
তদর্থং কর্ম্ম কৌন্তেয় মুক্তসঙ্গঃ সমাচর।।৯


অর্থঃ-(৯) যজ্ঞার্থ যে কর্ম্ম তদ্ভিন্ন অন্য কর্ম্ম মনুষ্যের বন্ধনের কারণ। হে কৌন্তেয় তুমি সেই উদ্দেশ্যে (যজ্ঞার্থ) অনাসক্ত হইয়া কর্ম্ম কর।


সহযজ্ঞাঃ প্রজাঃ সৃষ্ট্বা পুরোবাচ প্রজাপতিঃ।
অনেন প্রসবিষ্যধ্বমেষ বোহস্ত্বিষ্টকামধুক্।।১০


অর্থঃ-(১০) সৃষ্টির প্রারম্ভে প্রজাপতি যজ্ঞের সহিত প্রজা সৃষ্টি করিয়া বলিয়াছিলেন - তোমরা এই যজ্ঞদ্বারা উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হও; এই যজ্ঞ তোমাদের অভীষ্টপ্রদ হউক।


দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।
পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপ্ স্যথ।।১১


অর্থঃ-(১১) এই যজ্ঞদ্বারা তোমরা দেবগণকে (ঘৃতাহুতি প্রদানে) সংবর্দ্ধনা কর, সেই দেবগণও (বৃষ্ট্যাদি দ্বারা) তোমাদিগকে সংবর্দ্ধিত করুন; এইরূপে পরস্পরের সংবর্দ্ধনা দ্বারা পরম মঙ্গল লাভ করিবে।


ইষ্টান্ ভোগান্ হি বো দেবা দাস্যন্তে যজ্ঞভাবিতাঃ।
তৈর্দত্তানপ্রদায়ৈভ্যো যো ভুঙ্ ক্তে স্তেন এব সঃ।।১২


অর্থঃ-(১২) যেহেতু, দেবগণ যজ্ঞাদিদ্বারা সংবর্দ্ধিত হইয়া তোমাদিগকে অভীষ্ট ভোগ্যবস্তু প্রদান করেন, সুতরাং তাঁহাদিগের প্রদত্ত অন্নপানাদি যজ্ঞাদি-দ্বারা তাহাদিগকে প্রদান না করিয়া যে ভোগ করে সে নিশ্চয়ই চোর (দেবস্বাপহারী।


যজ্ঞাশিষ্টাশিনঃ সন্তো মুচ্যন্তে সর্ব্বকিল্বিষৈঃ।
ভুঞ্জতে তে ত্বঘং পাপা য পচন্ত্যাত্মকারণাৎ।।১৩


অর্থঃ-(১৩) যে সজ্জনগণ যজ্ঞাবশেষ অন্ন ভোজন করেন অর্থাৎ দেবতা, অতিথি প্রভৃতিকে অন্নাদি প্রদান করিয়া অবশিষ্ট ভোজন করেন তাঁহারা সর্ব্বপাপ হইতে মুক্ত হন। যে পাপাত্মারা কেবল আপন উদরপূরণার্থ অন্ন পাক করে, তাহারা পাপরাশিই ভোজন করে।


অন্নাদ্ ভবন্তি ভূতানি পর্জ্জন্যাদন্নসম্ভবঃ।
যজ্ঞাদ্ ভবতি পর্জ্জন্যো যজ্ঞঃ কর্ম্মসমুদ্ভবঃ।।১৪
কর্ম্ম ব্রহ্মোদ্ভবং বিদ্ধি ব্রহ্মাক্ষরসমুদ্ভবম্।
তস্মাৎ সর্ব্বগতং ব্রহ্ম নিত্যং যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিতম্।।১৫
এবং প্রবর্ত্তিতং চক্রং নানুবর্ত্তয়তীহ যঃ।
অঘায়ুরিন্দ্রিয়ারামো মোঘং পার্থ স জীবতি।।১৬


অর্থঃ-(১৪,১৫,১৬) প্রাণিসকল অন্ন হইতে উৎপন্ন হয়, মেঘ হইতে অন্ন জন্মে, যজ্ঞ হইতে মেঘ জন্মে, কর্ম্ম হইতে যজ্ঞের উৎপত্তি, কর্ম্ম বেদ হইতে উৎপন্ন জানিও এবং বেদ পরব্রহ্ম হইতে সমুদ্ভূত; সেই হেতু সর্ব্বব্যাপী পরব্রহ্ম সদা যজ্ঞে প্রতিষ্ঠিত আছেন। এইরূপে প্রবর্ত্তিত জগচ্চক্রের যে অনুবর্ত্তন না করে (অর্থাৎ যে যজ্ঞাদি কর্ম্মদ্বারা এই সংসার-চক্র জগচ্চক্রের যে অনুবর্ত্তন না করে (অর্থাৎ যে যজ্ঞাদি কর্মদ্বারা এই সংসার-চক্র পরিচালনের সহায়তা না করে) সে ইন্দ্রিয়সুখাসক্ত ও পাপজীবন; হে পার্থ, সে বৃথা জীবন ধারণ করে।


যস্ত্বাত্মরতিরেব স্যাদাত্মতৃপ্তশ্চ মানবঃ।
আত্মন্যেব চ সন্তুষ্টস্তস্য কার্য্যং ন বিদ্যতে।।১৭


অর্থঃ-(১৭) কিন্তু যিনি কেবল আত্মাতেই প্রীত, যিনি আত্মাতেই তৃপ্ত, যিনি কেবল আত্মাতেই সন্তুষ্ট থাকেন, তাঁহার নিজের কোন প্রকার কর্ত্তব্য নাই।


নৈব তস্য কৃতেনার্থো নাকৃতেনেহ কশ্চন।
ন চাস্য সর্ব্বভূতেষু কশ্চিদর্থব্যপাশ্রয়ঃ।।১৮


অর্থঃ-(১৮) যিনি আত্মারাম তাঁহার কর্মানুষ্ঠানে কোন প্রয়োজন নাই, কর্ম্ম হইতে বিরত থাকারও কোন প্রয়োজন নাই। সর্ব্বভূতের মধ্যে কাহারও আশ্রয়ে তাঁহার প্রয়োজন নাই (তিনি কাহারও আশ্রয়ে সিদ্ধকাম হইবার আবশ্যকতা রাখেন না)।


তস্মাদসক্তঃ সততং কার্যং কর্ম্ম সমাচর।
অসক্তো হ্যাচরন্ কর্ম্ম পরমাপ্নোতি পুরুষঃ।।১৯


অর্থঃ-(১৯) অতএব তুমি আসক্তিশূন্য হইয়া সর্ব্বদা কর্ত্তব্য কর্ম্ম সম্পাদন কর, কারণ অনাসক্ত হইয়া কর্মানুষ্ঠান করিলে পুরুষ পরমপদ (মোক্ষ) প্রাপ্ত হন।


কর্ম্মণৈব হি সং সিদ্ধিমাস্থিতা জনকাদয়ঃ।
লোকসংগ্রহমেবাপি সংপশ্যন্ কর্ত্তুমর্হসি।।২০


অর্থঃ-(২০) জনকাদি মহাত্মারা কর্ম্ম দ্বারাই সিদ্ধিলাভ করিয়াছেন। লোকরক্ষার দিকে দৃষ্টি রাখিয়াও তোমার কর্ম্ম করাই কর্ত্তব্য।


যদ্ যদাচরতি শ্রেষ্ঠস্তত্তদেবেতরো জনঃ।
স যৎ প্রমাণং কুরুতে লোকস্তদনুবর্ত্ততে।।২১


অর্থঃ-(২১) শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি যাহা যাহা অচরণ করেন, অপর সাধারণেও তাহাই করে। তিনি যাহা প্রামাণ্য বলিয়া বা কর্ত্তব্য বলিয়া গ্রহণ করেন, সাধারণ লোকে তাহারই অনুবর্ত্তন করে।


ন মে পার্থাস্তি কর্ত্তব্যং ত্রিষু লোকেষু কিঞ্চন।
নানবাপ্তমবাপ্তব্যং বর্ত্ত এব চ কর্ম্মণি।।২২


অর্থঃ-(২২) হে পার্থ, ত্রিলোক মধ্যে আমার করণীয় কিছু নাই, অপ্রাপ্ত বা প্রাপ্তব্য কিছু নাই, তথাপি আমি কর্মানুষ্ঠানেই ব্যাপৃত আছি।


যদি হ্যহং ন বর্ত্তেয় জাতু কর্ম্মণ্যতন্দ্রিতঃ।
মম বর্ত্মানুবর্ত্তন্তে মনুষ্যাঃ পার্থ সর্ব্বশঃ।।২৩


অর্থঃ-(২৩) হে পার্থ, যদি অনলস হইয়া কর্মানুষ্ঠান না করি, তবে মানবগণ সর্ব্বপ্রকারে আমারই পথের অনুবর্ত্তী হইবে। (কেহই কর্ম্ম করিবে না)।


উৎসীদেয়ুরিমে লোকা ন কুর্য্যাং কর্ম্ম চেদহম্।
সঙ্করস্য চ কর্ত্তা স্যামুপহন্যামিমাঃ প্রজাঃ।।২৪


অর্থঃ-(২৪) যদি আমি কর্ম্ম না করি তাহা হইলে এই লোক সকল উৎসন্ন যাইবে। আমি বর্ণ-সঙ্করাদি সামাজিক বিশৃঙ্খলার হেতু হইব এবং ধর্ম্মলোপহেতু প্রজাগণের বিনাশের কারণ হইব।


সক্তাঃ কর্ম্মণ্যবিদ্বাংসো যথা কুর্ব্বন্তি ভারত।
কুর্য্যাদ্বিদ্বাংস্তথাসক্তশ্চিকীর্ষুর্লোকসংগ্রহম্।।২৫


অর্থঃ-(২৫) হে ভারত, অজ্ঞ ব্যক্তিরা কর্ম্মে আসক্তিবিশিষ্ট হইয়া যেরূপ কর্ম করিয়া থাকে, জ্ঞানী ব্যক্তিরা অনাসক্ত চিত্তে লোকরক্ষার্থে সেইরূপ কর্ম্ম করিবেন।


ন বুদ্ধিভেদং জনয়েদজ্ঞানাং কর্ম্মসঙ্গিনাম্।
যোজয়েৎ সর্ব্বকর্ম্মাণি বিদ্বান্ যুক্তঃ সমাচরন্।।২৬


অর্থঃ-(২৬) জ্ঞানীরা কর্মে আসক্ত অজ্ঞানদিগের বুদ্ধিভেদ জন্মাইবেন না। আপনারা অবহিত হইয়া সকল কর্ম অনুষ্ঠান করিয়া তাহাদিগকে কর্ম্মে নিযুক্ত রাখিবেন।


প্রকৃতেঃ ক্রিয়মাণানি গুণৈঃ কর্ম্মাণি সর্ব্বশঃ।
অহঙ্কারবিমূঢ়াত্মা কর্ত্তাহমিতি মন্যতে।।২৭


অর্থঃ-(২৭) প্রকৃতির গুণসমূহদ্বারা সর্ব্বতোভাবে কর্মসকল সম্পন্ন হয়। যে অহঙ্কারে মুগ্ধচিত্ত সে মনে করে আমিই কর্ত্তা।


তত্ত্ববিত্তু মহাবাহো গুণকর্ম্মবিভাগয়োঃ।
গুণা গুণেষু বর্ত্তন্ত ইতি মত্বা ন সজ্জতে।।২৮


অর্থঃ-(২৮) কিন্তু হে মহাবাহো! যিনি সত্ত্বরজস্তমোগুণ ও মন, বুদ্ধি ইন্দ্রিয়াদির বিভাগ ও উহাদের পৃথক্ পৃথক্ কর্ম্ম-বিভাগ তত্ত্ব জানিয়াযছেন, তিনি ইন্দ্রিয়াদি ইন্দ্রিয়বিষয়ে প্রবৃত্ত আছে ইহা জানিয়া কর্ম্মে আসক্ত হন না, কর্ত্তৃত্বাভিমান করেন না।


প্রকৃতের্গুণসংমুঢ়াঃ সজ্জন্তে গুণকর্ম্মসু।
তানকৃৎস্নবিদো মন্দান্ কৃতস্নবিন্ন বিচালয়েৎ।।২৯


অর্থঃ-(২৯) যাহারা প্রকৃতির গুণে মোহিত তাহারা দেহেন্দ্রিয়াদি কর্ম্মে আসক্তিযুক্ত হয়; সেই সকল অল্পবুদ্ধি মন্দমতিদিগকে জ্ঞানিগণ কর্ম্ম হইতে বিচালিত করিবেন না।


ময়ি সর্ব্বাণি কর্ম্মাণি সংন্যস্যাধ্যাত্মচেতসা।
নিরাশীর্নির্ম্মমো ভূত্বা যুধ্যস্ব বিগতজ্বরঃ।।৩০


অর্থঃ-(৩০) কর্ত্তা ঈশ্বর, তাঁহারই উদ্দেশ্যে ভৃত্যবৎ কর্ম্ম করিতেছি, এইরূপ বিবেকবুদ্ধি সহকারে সমস্ত করম্ম আমাতে সমর্পণ করিয়া কামনাশূন্য ও মমতাশূন্য হইয়া শোকত্যাগপূর্ব্বক তুমি যুদ্ধ কর।


যে মে মতমিদং নিত্যমনুতিষ্ঠন্তি মানবাঃ।
শ্রদ্ধাবন্তোহনসূয়ন্তো মূচ্যন্তে তেহপি কর্ম্মভিঃ।।৩১


অর্থঃ-(৩১) যে মানবগণ শ্রদ্ধাবান ও অসূয়াশূন্য হইয়া আমার এই মতের অনুষ্ঠান করে, তাহারাও কর্ম্মবন্ধন হইতে মুক্ত হয়।


যে ত্বেতদভ্যসুয়ন্তো নানুতিষ্ঠন্তি মে মতম্।
সর্ব্বজ্ঞানবিমুঢ়াংস্তান্ বিদ্ধি নষ্টানচেতসঃ।।৩২


অর্থঃ-(৩২) যাহারা অসূয়াপরবশ হইয়া আমার এই মতের অনুষ্ঠান করে না, সেই বিবেকহীন ব্যক্তিগণকে সর্ব্বজ্ঞান-বিমূঢ় ও বিনষ্ট বলিয়া জানিও।


সদৃশং চেষ্টতে স্বস্যাঃ প্রকৃতের্জ্ঞানবানপি।
প্রকৃতিং যান্তি ভূতানি নিগ্রহঃ কিং করিষ্যতি।।৩৩


অর্থঃ-(৩৩) জ্ঞানবান্ ব্যক্তিও নিজ প্রকৃতির অনুরূপ কর্ম্মই করিয়া থাকেন। প্রাণিগণ প্রকৃতিরই অনুসরণ করে; ইন্দ্রিয়-নিগ্রহে কি করিবে?


ইন্দ্রিয়স্যেন্দ্রিয়স্যার্থে রাগদ্বেষৌ ব্যবস্থিতৌ।
তয়োর্ন বশমাগচ্ছেৎ তৌ হ্যস্য পরিপন্থিনৌ।।৩৪


অর্থঃ-(৩৪) সকল ইন্দ্রিয়েরই স্ব স্ব বিষয়ে রাগদ্বেষ অবশ্যম্ভাবী। ঐ রাগদ্বেষের বশীভূত হইও না; উহারা জীবের শত্রু (অথবা, শ্রেয়োমার্গের বিঘ্নকারক)।


শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্ম্মো ভয়াবহঃ।।৩৫


অর্থঃ-(৩৫) স্বধর্ম্ম কিঞ্চিদ্দোষবিশিষ্ট হইলেও উহা উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম্মাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। স্বধর্ম্মে নিধনও কল্যাণকর, কিন্তু পরধর্ম গ্রহণ করা বিপজ্জনক।


অর্জ্জুন উবাচ -
অথ কেন প্রযুক্তোহয়ং পাপং চরতি পুরুষঃ।
অনিচ্ছন্নপি বার্ষ্ণেয় বলাদিব নিয়োজিতঃ।।৩৬


অর্থঃ-(৩৬) অর্জ্জুন কহিলেন - হে কৃষ্ণ, লোকে কাহাদ্বারা প্রযুক্ত হইয়া অনিচ্ছা-সত্ত্বেও যেন বলপুর্ব্বক নিয়োজিত হইয়াই পাপাচরণ করে।


শ্রীভগবান্ উবাচ -
কাম এষ ক্রোধ এষ রজোগুণসমুদ্ভবঃ।
মহাশনো মহাপাপ্মা বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম্।।৩৭


অর্থঃ-(৩৭) ইহা কাম, ইহাই ক্রধ। ইহা রজোগুণোৎপন্ন, ইহা দুস্পুরণীয় এবং অতিশয় উগ্র। ইহাকে সংসারে শত্রু বলিয়া জানিবে।


ধুমেনাব্রিয়তে বহ্নির্যথাদর্শো মলেন চ।
যথোল্বেনাবৃতো গর্ভস্তথা তেনেদমাবৃতম্।।৩৮


অর্থঃ-(৩৮) যেমন ধূমদ্বারা বহ্নি আবৃত থাকে, মলদ্বারা দর্পণ আবৃত হয়, জরায়ূদ্বারা গর্ভ আবৃত থাকে, সেইরূপ কামের দ্বারা জ্ঞান আবৃত থাকে।  [বিষয়-বাসনা থাকিতে আত্মজ্ঞানের উদয় হয় না। যেমন ধূম অপসারিত হইলে অগ্নি প্রকাশিত হয়, ধূলিমল অপসারিত হইলে দর্পণের স্বচ্ছতা প্রতিভাত হয়, প্রসবের দ্বারা জরায়ূ প্রসারিত হইলে ভ্রুণের প্রকাশ হয়, সেইরূপ বিষয়-বাসনা বিদূরিত হলে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয় (সংসারের ক্ষয় হয়)।]


আবৃতং জ্ঞানমেতেন জ্ঞানিনো নিত্যবৈরিণা।
কামরূপেণ কৌন্তেয়! দুষ্পুরেণানলেন চ।।৩৯


অর্থঃ-(৩৯) হে কৈন্তেয়, জ্ঞানীদিগের নিত্যশত্রু এই দুস্পূরণীয় অগ্নিতুল্য কামদ্বারা জ্ঞান আচ্ছন্ন থাকে।


ইন্দ্রিয়াণি মনোবুদ্ধিরস্যাধিষ্ঠানমুচ্যতে।
এতৈর্ব্বিমোহয়ত্যেষ জ্ঞানমাবৃত্য দেহিনম্।।৪০


অর্থঃ-(৪০) ইন্দ্রিয়সকল, মন ও বুদ্ধি - ইহারা কামের অধিষ্ঠান বা আশ্রয়স্থান বলিয়া কথিত হয়। কাম ইহাদিগকে অবলম্বন করিয়া জ্ঞানকে আচ্ছন্ন করিয়া জীবকে মুগ্ধ করে।


তস্মাৎ ত্বমিন্দ্রিয়াণ্যাদৌ নিয়ম্য ভরতর্ষভ।
পাপমানং প্রজহি হ্যেনং জ্ঞানবিজ্ঞাননাশনম্।৪১


অর্থঃ-(৪১) কাম, প্রবল শত্রু। ইন্দ্রিয়াদি উহার অবলম্বন বা আশ্রয়স্বরূপ।  তুমি প্রথমে কামের অবলম্বন স্বরূপ ইন্দ্রিয়দিগকে জয় কর, তবেই কাম জয় করিতে পারিবে।


ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুরিন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ।
মনসস্তু পরা বুদ্ধির্যোবুদ্ধে পরতস্তু সঃ।।৪২


অর্থঃ-(৪২) ইন্দ্রিয়সকল শ্রেষ্ঠ বলিয়া কথিত হয়; ইন্দ্রিয়গণ অপেক্ষা মন শ্রেষ্ঠ; মন অপেক্ষা বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ; বুদ্ধি হইতে যিনি শ্রেষ্ঠ তিনিই আত্মা।


এবং বুদ্ধে পরং বুদ্ধ সংস্তভ্যাত্মানমাত্মনা।
জহি শত্রুং মহাবাহো! কামরূপং দুরাসদং।।৪৩


অর্থঃ-(৪৩) অথবা নিজেই নিজেকে সংযত করিয়া কামরূপ দুর্জ্জয় শত্রুকে মারিয়া ফেল (লোকমান্য তিলক); অথবা, নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধিদ্বারা মনকে নিশ্চল করিয়া কামরূপ দুর্জ্জয় শত্রু (কামকে) বিনাশ কর (স্বামিকৃত টীকা)।

Wednesday, August 24, 2011

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : দ্বিতীয়োহধ্যায় (শ্লোক অর্থসহ)


সঞ্জয় উবাচ -
তং তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ।।১

অর্থঃ-(১) সঞ্জয় কহিলেন - তখন মধূসুদন কৃপাবিষ্ট অশ্রুপূর্ণলোচন বিষন্ন অর্জ্জুনকে এই কথা বলিলেন।

শ্রীভগবানুবাচ -
কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্।
অনার্য্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্ত্তিকরমর্জ্জুন।।২

অর্থঃ-(২) শ্রীভগবান্ উবাচ - হে অর্জ্জুন ! এই সঙ্কটসময়ে অনার্য্য-জনোচিত, স্বর্গহানিকর, অকীর্ত্তিকর তোমার এই মোহ কোথা হইতে উপস্থিত হইল?

ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ নৈতৎ ত্বয্যুপপদ্যতে।
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্ব্বল্যং ত্যক্ত্বোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।৩

অর্থঃ-(৩) হে পার্থ, কাতর হইও না। এইরূপ পৌরুষহীনতা তোমাকে শোভা পায় না। হে পরন্তপ ! তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্ব্বলতা ত্যাগ করিয়া (যুদ্ধার্থে) উত্থিত হও।

অর্জ্জুন উবাচ -
কথং ভীস্মমহং সংখ্যে দ্রোণঞ্চ মধুসূদন।
ইযুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পুজার্হাবরিসূদন।।৪

অর্থঃ-(৪) অর্জ্জুন বলিলেন - হে শত্রুমর্দ্দন মধুসূদন, আমি যুদ্ধকালে পূজনীয় ভীস্ম ও দ্রোণের সহিত কিরূপে বাণের দ্বারা প্রতিযুদ্ধ করিব ? (অর্থাৎ) তাঁহারা আমার শরীরে বাণ নিক্ষেপ করিলেও আমি গুরুজনের অঙ্গে অস্ত্র নিক্ষেপ করিতে পারিব না।

গুরূনহত্বা হি মহানুভাবান্ শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে।
হত্বার্থকামাংস্তু গুরূনিহৈব ভুঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্।।৫

অর্থঃ-(৫) মহাবুভব গুরুদিগকে বধ না করিয়া ইহলোকে ভিক্ষান্ন-ভোজন করাও শ্রেয়ঃ। কেননা গুরুদিগকে বধ করিয়া ইহলোকে যে অর্থকাম ভোগ করিব তাহা ত (গুরুজনের) রুধির-লিপ্ত।

ন চৈতদ্বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো যদ্বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ।
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্তেহবস্থিতাঃ প্রজুখে ধার্ত্তরাষ্ট্রাঃ।।৬

অর্থঃ-(৬) আমরা জয়ী হই অথবা আমাদিগকে ইহারা জয় করুক, এই উভয়ের মধ্যে কোন্ টি শ্রেয়স্কর তাহা বুঝিতে পারিতেছি না, - যাহাদিগকে বধ করিয়া বাঁচিয়া থাকিতে চাহি না, সেই ধৃতরাষ্ট্র-পুত্রগণ সম্মুখে অবস্থিত।

কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্ম্মসংমূঢ়চেতাঃ।
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রূহি তন্মে শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্।।৭

অর্থঃ-(৭) (গুরুজনদিগকে বধ করিয়া কিরূপে প্রাণ ধারণ করিব এইরূপ চিন্তাপ্রযুক্ত) চিত্তের দীনতায় আমি অভিভূত হইয়াছি; প্রকৃত ধর্ম কি এ সন্বন্ধে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইয়াছে; যাহা আমার ভাল হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া তাহা বল, আমি তোমার শিষ্য, তোমার শরণাপন্ন, আমাকে উপদেশ দাও। (আমাকে আর তুমি সখা বলিয়া মনে করিও না, আমি তোমার শিষ্য)।

ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাৎ যচ্ছোকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভুমাবসপত্নমৃদ্ধং রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্।।৮

অর্থঃ-(৮) পৃথিবীতে নিস্কন্টক সমৃদ্ধ রাজ্য এবং সুরলোকের আধিপত্য পাইলেও যে শোক আমার ইন্দ্রিয়গণকে বিশোষণ করিবে তাহা কিসে যাইবে, আমি দেখিতেছি না।

সঞ্জয় উবাচ -
এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপঃ।
ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তূষ্ণীং বভুব হ।।৯

অর্থঃ-(৯) সঞ্জয় কহিলেন - শত্রুতাপন অর্জ্জুন হৃষীকেশ গোবিন্দকে এইরূপ বলিয়া 'আমি যুদ্ধ করিব না' এই কথা কহিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিলেন (নীরব রহিলেন)।

তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষিদন্তমিদং বচঃ।।১০

অর্থঃ-(১০) হে ভারত (ধৃতরাষ্ট্র) ! হৃষীকেশ উভয় সেনার মধ্যে বিষাদপ্রাপ্ত অর্জ্জুনকে হাসিয়া এই কথা বলিলেন।

শ্রীভগবানুবাচ -
অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পণ্ডিতাঃ।।১১

অর্থঃ-(১১) শ্রীভগবান্ বলিলেন- যাহাদিগের জন্য শোক করার কোন কারণ নাই, তুমি তাহাদিগের জন্য শোক করিতেছ, আবার পণ্ডিতের ন্যায় কথা বলিতেছ। কিন্তু যাঁহারা প্রকৃত তত্ত্বজ্ঞানী তাঁহারা কি মৃত কি জীবিত, কাহারো জন্য শোক করেন না।

ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ।
ন চৈব ন ভবিশ্যামঃ সর্ব্বে বয়মতঃপরম্।।১২

অর্থঃ-(১২) আমি পূর্ব্বে ছিলাম না, বা তুমি ছিলে না বা এই নৃপতিগণ ছিলেন না, আমন নহে (অর্থাৎ সকলেই ছিলাম)। আর, পরে আমরা সকলে থাকিব না তাহাও নহে (অর্থাৎ পরেও সকলে থাকিব)।

দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা।
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তির্ধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।১৩

অর্থঃ-(১৩) জীবের এই দেহে বাল্য, যৌবন ও বার্দ্ধক্য, কালের গতিতে উপস্থিত হয়। তেমনি কালের গতিতে দেহান্ত্র প্রাপ্তি হয়। জ্ঞানিগণ তাহাতে মুগ্ধ হন না।

মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তাংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।।১৪

অর্থঃ-(১৪) হে কৈন্তেয়, ইন্দ্রিয়বৃত্তির সহিত বিষয়াদির সংযোগই শীতোষ্ণাদি সুখদুঃখ প্রদান করে। সেগুলির একবার উৎপত্তি হয়, আবার বিনাশ হয়, সুতরাং ওগুলি অনিত্য। অতএব সে সকল সহ্য কর।

যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ।
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে।।১৫

অর্থঃ-(১৫) হে পুরুষশ্রেষ্ঠ, যে স্থিরবুদ্ধি ব্যক্তি এই সকল বিষয়স্পর্শ-জনিত সুখদুঃখ সমভাবে গ্রহণ করেন, উহাতে বিচলিত হন না, তিনি অমৃতত্ব লাভে সমর্থ হন।

নাসতো বিদ্যতে ভাবো নভাবো বিদ্যতে সতঃ।
উভয়োরপি দৃষ্টোহন্তস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।১৬

অর্থঃ-(১৬) অসৎ বস্তুর ভাব (সত্তা, স্থায়িত্ব) নাই, সৎবস্তুর অভাব (নাশ) নাই; তত্ত্বদর্শিগণ এই সদসৎ উভয়েরই চরম দর্শন করিয়াছেন (স্বরূপ উপলব্ধি করিয়াছেন)।

অবিনাশিতু তদ্বিদ্ধি যেন সর্ব্বমিদং ততম্।
বিনাশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্ত্তুমর্হতি।১৭

অর্থঃ-(১৭) যিনি এই সকল (দৃশ্য জগৎ) ব্যাপিয়া আছেন তাঁহাকে অবিনাশী জানিও। কেহই এই অব্যয় স্বরূপের বিনাশ করিতে পারে না।

অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ।
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত।।১৮

অর্থঃ-(১৮) দেহাশ্রিত আত্মার এই সকল দেহ নশ্বর বলিয়া উক্ত হইয়াছে। কিন্তু আত্মা নিত্য, অবিনাশী, অপ্রমেয় (স্বপ্রকাশ)। অতএব, হে অর্জুন, যুদ্ধ কর (আত্মার অবিনাশিতা ও দেহাদির নশ্বরত্ব স্মরণ করিয়া কাতরতা ত্যাগ কর। স্বধর্ম পালন কর)। 

য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্ত ন হন্যতে।।১৯

অর্থঃ-(১৯) যে আত্মাকে হন্তা বলিয়া জানে এবং যে উহাকে হত বলিয়া মনে করে, তাহারা উভয়েই আত্মতত্ত্ব জানে না। ইনি হত্যা করেন না, হতও হন না।

ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিৎ নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।২০

অর্থঃ-(২০) এই আত্মা কখনো জন্মেন না বা মরেন না। ইনি অন্যান্য জাত বস্তুর ন্যায় জন্মিয়া অস্তিত্ব লাভ করেন না অর্থাৎ ইনি সৎরূপে নিত্য বিদ্যমান। ইনি জন্মরহিত, নিত্য, শাশ্বত এবং পুরাণ; শরীর হত হইলেও ইনি হত হয়েন না।২০

বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্।
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হন্তি কম্।।২১

অর্থঃ-(২১) যিনি আত্মাকে অবিনাশী, নিত্য, অজ, অব্যয় বলিয়া জানেন, হে পার্থ, সে পুরুষ কি প্রকারে কাহাকে হত্যা করেন বা করান?

বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায় নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।।২২

অর্থঃ-(২২) যেমন মনুষ্য জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করিয়া নূতন বস্ত্র গ্রহণ করে, সেইরূপ আত্মা জীর্ণ শরীর পরিত্যাগ করিয়া অন্য নূতন শরীর পরিগ্রহ করে।

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।২৩

অর্থঃ-(২৩) শস্ত্রসকল ইহাকে ছেদন করিতে পারে না, অগ্নিতে দহন করিতে পারে না, জলে ভিজাইতে পারে না, বায়ুতে শুস্ক করিতে পারে না।

অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোষ্য এব চ।
নিত্যঃ সর্ব্বগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।
অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্য্যোহয়মুচ্যতে।।২৪

অর্থঃ-(২৪) এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য, অশোষ্য। ইনি নিত্য, সর্বব্যাপী, স্থির, অচল, সনাতন, অব্যক্ত, অচিন্ত্য, অবিকার্য্য বলিয়া কথিত হন।

তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি।।২৫

অর্থঃ-(২৫) অতএব আত্মাকে এই প্রকার জানিয়া তোমার শোক করে উচিত নয়।

অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি।।২৬

অর্থঃ-(২৬) আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মা সর্ব্বদা দেহের সঙ্গে জন্মে এবং দেহের সঙ্গেই বিনষ্ট হয়, তথাপি, হে মহাবাহো, তোমার শোক করা উচিত নয়। (দেহনাশে আত্মারও নাশ হয় ইহা স্বীকার করিয়া লইলেও শোক করা উচিত নয়। কেননা, জন্মমৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।)

জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ।
তস্মাদপরিহার্য্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।২৭

অর্থঃ-(২৭) যে জন্মে তার মরণ নিশ্চিত, যে মরে তার জন্ম নিশ্চিত; সুতরাং অবশ্যম্ভাবী বিষয়ে তোমার শোক করা উচিত নয়।

অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।।২৮

অর্থঃ-(২৮) হে ভারত (অর্জ্জুন) ! জীবগণ আদিতে অব্যক্ত, মধ্যে ব্যক্ত এবং বিনাশান্তে অব্যক্ত থাকে। তাহাতে শোক বিলাপ কি?

আশ্চর্য্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনমাশ্চর্য্যবদ্ বদতি তথৈব চান্যঃ।
আশর্য্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।।২৯

অর্থঃ-(২৯) কেহ আত্মাকে আশ্চর্য্যবৎ কিছু বলিয়া বোধ করেন, কেহ ইহাকে আশ্চর্য্যবৎ কিছু বলিয়া বর্ণনা করেন, কেহ বা ইনি আশ্চর্য্যবৎ কিছু, এই প্রকার কথাই শুনেন। কিন্তু শুনিয়াও কেহ ইহাকে জানিতে পারেন না।

দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্ব্বস্য ভারত।
তস্মাৎ সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।৩০

অর্থঃ-(৩০) হে ভারত, জীবসকলের দেহে আত্মা সর্বদাই অবধ্য, অতএব কোন প্রাণীর জন্যই তোমার শোক করা উচিত নহে।

স্বধর্ম্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি।
ধর্ম্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে।।৩১

অর্থঃ-(৩১) স্বধর্ম্মের দিকে দৃষ্টি রাখিয়াও তোমার ভীত-কম্পিত হয়া উচিত নহে। ধর্মাযুদ্ধ অপেক্ষা ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছু নাই।

যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্।
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্।।৩২

অর্থঃ-(৩২) হে পার্থ, এই যুদ্ধ আপনা হইতেই উপস্থিত হইয়াছে, ইহা মুক্ত স্বর্গদ্বার স্বরূপ। ভাগ্যবান্ ক্ষত্রিয়েরাই ঈদৃশ যুদ্ধ লাভ করিয়া থাকেন।

অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্ম্যং সংগ্রামং ন করিষ্যসি।
ততঃ স্বধর্ম্মং কীর্ত্তিং চ হিত্বা পাপমবাপ্স্যসি।।৩৩

অর্থঃ-(৩৩) আর যদি তুমি ধর্ম্ম্য যুদ্ধ না কর তবে স্বধর্ম্ম ও কীর্ত্তি ত্যাগ করিয়া তুমি পাপযুক্ত হইবে।

অকীর্ত্তিঞ্চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেহব্যয়াম্।
সম্ভাবিতস্য চাকীর্ত্তির্মরণাদতিরিচ্যতে।।৩৪

অর্থঃ-(৩৪) আরও দেখ, সকল লোকে চিরকাল তোমার অকীর্ত্তি ঘোষণা করিবে। সম্মানিত ব্যক্তির পক্ষে অকীর্ত্তি মরণ অপেক্ষা অধিক, অর্থাৎ অকীর্ত্তি অপেক্ষা মরণও শ্রেয়ঃ।

ভয়াদ্রণাদুপরতং মংস্যন্তে ত্বাং মহারথাঃ।
যেষাষ্ণ ত্বং বহুমতো ভূত্বা যাস্যসি লাঘবম্।।৩৫

অর্থঃ-(৩৫) মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়বশতঃ যুদ্ধে বিরত হইতেছ, দয়াবশতঃ নহে। সুতরাং যাহারা তোমাকে বহু সম্মান করেন তাহাদিগের নিকট তুমি লঘুতা প্রাপ্ত হইবে।

অবাচ্যবাদাংশ্চ বহূন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ।
নিন্দন্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম্।।৩৬

অর্থঃ-(৩৬) তোমার শত্রুরাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া অনেক অবাচ্য কথা বলিবে; তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখকর আর কি আছে?

হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্।
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কৃতনিশ্চয়ঃ।।৩৭

অর্থঃ-(৩৭) যুদ্ধে হত হইলে স্বর্গ পাইবে, জয়লাভ করিলে পৃথিবী ভোগ করিবে, সুতরাং হে কৌন্তেয়, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উত্থান কর।

সুখেদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভৌ জয়াজয়ৌ
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি।।৩৮

অর্থঃ-(৩৮) অতএব, সুখদুঃখ, লাভ-অলাভ, জয়-পরাজয় তুল্যজ্ঞান করিয়া যুদ্ধার্থ উদ্ যুক্ত হও। এইরূপ করিলে পাপভাগী হইবে না।

এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে ত্বিমাং শৃণু।
বুদ্ধ্যা যুক্তো যয়া পার্থ কর্ম্মবন্ধং প্রহাস্যসি।।৩৯

অর্থঃ-(৩৯) হে পার্থ, তোমাকে এতক্ষণ সাংখ্য নিষ্ঠা-বিষয়ক জ্ঞান উপদেশ দিলাম, এক্ষণ যোগবিষয়ক জ্ঞান শ্রবণ কর (যাহা এক্ষণ বলিতেছি) এই জ্ঞান লাভ করিলে কর্ম্মবন্ধন ত্যাগ করিতে পারিবে।

নেহাভিক্রমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে
স্বল্পমপ্যস্য ধর্ম্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।।৪০

অর্থঃ-(৪০) ইহাতে (এই নিস্কাম কর্ম্মযোগে) আরব্ধ কর্ম্ম নিস্ফল হয় না এবং (ত্রুতিবিদ্যুতি-জনিত) পাপ বা বিঘ্ন হয় না, ধর্ম্মের অল্প আচরণও মহাভয় হইতে ত্রাণ করে।

ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন।
বহুশাখা হ্যনস্তাশ্চ বুদ্ধয়োহব্যবসায়িনাম্।।৪১

অর্থঃ-(৪১) ইহাতে (এই নিস্কাম কর্ম্মযোগে) ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধি (নিস্কাম ভাবে কর্ম্ম করিয়াই আমি ত্রাণ পাইব এইরূপ নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি) একই হয় অর্থাৎ একনিষ্ঠই থাকে, নানাদিকে ধাবিত হয় না। কিন্তু অব্যবসায়ীদিগের (অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিগণের) বুদ্ধি বহুশাখাবিশিষ্ট ও অনন্ত (সুতরাং নানাদিকে ধাবিত হয়)।

যামিমাং পুস্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ।
বেদবাদরতাঃ পার্থ নান্যদস্তীতিবাদিনঃ।।৪২
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্ম্মফলপ্রদাম্
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈর্শ্বয্যগতিং প্রতি।।৪৩
ভোগৈর্শ্বয্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্।
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।।৪৪

অর্থঃ-(৪২, ৪৩, ৪৪) হে পার্থ, অল্পবুদ্ধি ব্যক্তিগণ বেদের কর্ম্মকাণ্ডের স্বর্গফলাদি প্রকাশক প্রীতিকর বাক্যে অনুরক্ত, তাহারা বলে বেদোক্ত কাম্যকর্ম্মাত্মক ধর্ম্ম ভিন্ন আর কিছু ধর্ম্ম নাই, তাহাদের চিত্ত কামনা-কলুষিত, স্বর্গই তাহাদের পরম পুরুষার্থ, তাহারা ভোগৈশ্বর্য্য লাভের উপায়স্বরূপ বিবিধ ক্রিয়াকলাপের প্রশংসাসূচক আপাতোমনোরম বেদবাক্য বলিয়া থাকে; এই সকল শ্রবণ-রমণীয় বাক্যদ্বারা অপহৃতচিত্ত, ভোগৈশ্বর্য্যে আসক্ত ব্যক্তিগণের কার্য্যাকার্য্য নির্ণায়ক বুদ্ধি এক বিষয়ে স্থির থাকিতে পারে না (ঈশ্বরে একনিষ্ঠ হয় না)।

ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জ্জুন।
নির্দ্বন্ধো নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্।।৪৫

অর্থঃ-(৪৫) হে অর্জ্জুন, বেদসমূহ ত্রৈগুণ্য-বিষয়ক, তুমি নিস্ত্রৈগুণ্য হও - তুমি নির্দ্বন্দ্ব, নিত্যসত্ত্বস্থ, যোগ-ক্ষেমরহিত ও আত্মবান্ হও।

যাবানর্থ উদপানে সর্ব্বতঃ সংপ্লুতোদকে।
তাবান্ সর্ব্বেষু বেদেষু ব্রাহ্মণস্য বিজানতঃ।।৪৬

অর্থঃ-(৪৬) বাপীকূপতপাগাদি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে প্রয়োজন সিদ্ধ হয়, এক বিস্তীর্ণ মহাজলাশয়ে সেই সমস্তই সিদ্ধ হয়; সেইরূপ বেদোক্ত কাম্যকর্ম্মসমূহে যে ফল লাভ হয়, ব্রহ্মবেত্তা ব্রহ্মনিষ্ঠ পুরুষের সেই সমস্তই লাভ হয়।

কর্ম্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন।
মা কর্ম্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্ম্মণি।।৪৭

অর্থঃ-(৪৭) কর্ম্মেই তোমার অধিকার, কর্ম্মফলে কখনও তোমার অধিকার নাই। কর্ম্মফল যেন তোমার কর্ম্মপ্রবৃত্তির হেতু না হয় কর্ম্মত্যাগেও যেন তোমার প্রবৃত্তি না হয়।

যোগস্থঃ কুরু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ধনঞ্জয়।
সিদ্ধ্যসিদ্ধোঃ সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।৪৮

অর্থঃ-(৪৮) হে ধনঞ্জয়, যোগস্থঃ হইয়া, ফলাসক্তি বর্জ্জন করিয়া, সিদ্ধি ও অসিদ্ধি তুল্যজ্ঞান করিয়া তুমি কর্ম্ম কর। এইরূপ সমত্য-বুদ্ধিকেই যোগ কহে।

দূরেণ হ্যবরং কর্ম্ম বুদ্ধিযোগাদ্ধনঞ্জয়।
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ।।৪৯

অর্থঃ-(৪৯) হে ধনঞ্জয়, কেবল বাহ্য কর্ম্ম বুদ্ধিযোগ অপেক্ষা নিতান্তই নিকৃষ্ট; অতএব তুমি সমত্ববুদ্ধির আশ্রয় লও; যাহারা ফলের উদ্দেশ্যে কর্ম্ম করে, তাহার দীন, কৃপার পাত্র।

বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে।
তস্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্ম্মসু কৌশলম্।।৫০

অর্থঃ-(৫০) সমত্ববুদ্ধিযুক্ত নিস্কাম কর্ম্মী ইহলোকেই সুকৃত দুস্কৃত উভয়ই ত্যাগ করেন। সুতরাং তুমি যোগের অনুষ্ঠান কর; কর্ম্মে কৌশলই যোগ।

কর্ম্মজং বুদ্ধিযুক্তা হি ফলং ত্যক্ত্বা মনীষিণঃ।
জন্মবন্ধবিনির্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম্।।৫১

অর্থঃ-(৫১) সমত্ববুদ্ধিযুক্ত জ্ঞানিগণ কর্ম্মকরিলেও কর্ম্মজনিত ফলে আবদ্ধ হয়েন না, সুতরাং তাঁহারা জন্মরূপ বন্ধন অর্থাৎ সংসার বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া সর্ব্বপ্রকার উপদ্রবরহিত বিষ্ণুপদ বাঁ মোক্ষপদ প্রাপ্ত হন।

যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি।
তদা গন্তাসি নির্ব্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ।।৫২

অর্থঃ-(৫২) যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গহনকানন অতিক্রমকরিবে, তখন তুমি শ্রুত ও শ্রোতব্য বিষয়ে বৈরাগ্য প্রাপ্ত হইবে।

শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা।
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাপ্স্যসি।।৫৩

অর্জ্জুন উবাচ -
স্থিতপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব।
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম্।।৫৪

অর্থঃ-(৫৩) লৌকিক ও বৈদিক নানাবিধ ফলকথা শ্রবণে বিক্ষিপ্ত তোমার বুদ্ধি যখন সমাধিতে নিশ্চল হইয়া থাকিবে তখন তুমি(সাম্যবুদ্ধিরূপ) যোগ প্রাপ্ত হইবে।

শ্রীভগবানুবাচ -
প্রজহাতি যদা কামান্ সর্ব্বান্ পার্থ মণগতান্।
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে।।৫৫

অর্থঃ-(৫৫) শ্রীভগবান্ বলিলেন - হে পার্থ, যখন কেহ সমস্ত মনোগত কামনা বর্জ্জন করিয়া আপনাতেই আপনি তুষ্ট থাকেন, তখন তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ বলিয়া কথিত হন।

দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।।৫৬

অর্থঃ-(৫৬) যিনি দুঃখে উদ্বেগশূন্য, সুখে স্পৃহাশূন্য, যাঁহার অনুরাগ, ভয় এবং ক্রোধ নিবৃত্ত হইয়াছে, তাঁহাকে স্থিতপ্রজ্ঞ মুনি বলা যায়।

যঃ সর্ব্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৫৭

অর্থঃ-(৫৭) যিনি দেহ-জীবনাদি সকল বিষয়েই শুভ প্রাপ্তিতে সন্তোষ বাঁ অশুভ প্রাপ্তিতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন না, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।

যদা সংহরতে চায়ং কুর্ম্মোহঙ্গানীব সর্ব্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৫৮

অর্থঃ-(৫৮) কচ্ছপ যেমন কর-চরণাদি অঙ্গসকল সঙ্কুচিত করিয়া রাখে, তেমনি যিনি রূপরসাদি ইন্দ্রিয়ের বিষয় হইতে ইন্দ্রিয়সকল সংহরণ করিয়া লন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।

বিষয়া বিনিবর্ত্তন্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জ্জং রসোহপ্যস্য পরং দৃষ্টা নিবর্ত্ততে।।৫৯

অর্থঃ-(৫৯) ইন্দ্রিয়দ্বারা বিষয়গ্রহণে অপ্রবৃত্ত ব্যক্তির বিষয়োপভোগ নিবৃত্ত হয় বটে, কিন্তু বিষয়-তৃষ্ণা নিবৃত্ত হয় না। কিন্তু সেই পরম পুরুষকে দেখিয়া স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তির বিষয়-বাসনাও নিবৃত্ত হয়।

যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ।
ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ।।৬০

অর্থঃ-(৬০) হে কৌন্তেয়, প্রমাথী ইন্দ্রিয়গণ সংযমে যত্নশীল, বিবেকী পুরুষেরও চিত্তকে বলপূর্ব্বক হরণ করে (বিষয়াসক্ত করে)।

তানি সর্ব্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ।
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬১

অর্থঃ-(৬১) যিনি আমার অনন্যভক্ত তিনি সেই সকল ইন্দ্রিয়কে সংযত করিয়া আমাকে চিত্ত সমাহিত করিয়া অবস্থান করেন। তাদৃশ সমাহিতচিত্ত ব্যক্তিরই ইন্দ্রিয়-সকল বশীভূত হয়, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ।

ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষুপুজায়তে।
সঙ্গাৎ সংজায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।৬২
ক্রোধাদ্ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।৬৩

অর্থঃ-(৬২-৬৩) বিষয়-চিন্তা করিতে করিতে মনুষ্যের তাহাতে আসক্তি জন্মে, আসক্তি হইতে কামনা অর্থাৎ সেই বিষয় লাভের অভিলাষ জন্মে, সেই কামনা কোন কারণে প্রতিহত বা বাধা প্রাপ্ত হইলে প্রতিবোধকের প্রতি ক্রোধ জন্মে, ক্রোধ হইতে মোহ, মোহ হইতে স্মৃতিভ্রংশ, স্মৃতিভ্রংশ  হইতে বুদ্ধিনাশ, বুদ্ধিনাশ হইতে বিনাশ ঘটে।

রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্।
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি।।৬৪

অর্থঃ-(৬৪) কিন্তু যিনি বিধেয়াত্মা অর্থাৎ যাহার মন নিজের বশবর্ত্তী, তিনি অনুরাগ ও বিদ্বেষ হইতে বিমুক্ত, আত্মবশীভূত ইন্দ্রিয়গণদ্বারা বিষয় উপভোগ করিয়া আত্মপ্রসাদ লাভ করেন।

প্রসাদে সর্ব্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্য্যবতিষ্ঠতে।।৬৫

অর্থঃ-(৬৫) চিত্তপ্রসাদ জন্মিলে এই পুরুষের সমস্ত দুঃখের নিবৃত্তি হয়, যেহেতু প্রসন্নচিত্ত ব্যক্তির বুদ্ধি শীঘ্র উপাস্য বস্তুতে স্থিতি লাভ করে।

নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা।
ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্।।৬৬

অর্থঃ-(৬৬) যিনি অযুক্ত অর্থাৎ যাঁহার চিত্ত অসমাহিত ও ইন্দ্রিয় অবশীকৃত, তাঁহার আত্ম-বিষয়া বুদ্ধিও হয় না, চিন্তাও হয় না। (যাঁহার আত্ম-বিষয়া) চিন্তা নাই, তাঁহার শান্তি নাই, যাঁহার শান্তি নাই, তাঁহার সুখ কোথায়?

ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে।
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি।।৬৭

অর্থঃ-(৬৭) মন বিষয়ে প্রবর্ত্তমান ইন্দ্রিয়গণের যেটীকে অনুবর্ত্তন করে, সেই একটী ইন্দ্রিয়ই, যেমন বায়ু জলের উপরিস্থিত নৌকাকে বিচলিত করে, তদ্রূপ উহার প্রজ্ঞা হরণ করে।

তস্মাদ্ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্ব্বশঃ
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬৮

অর্থঃ-(৬৮) হে মহাবাহু ! (যখন ইন্দ্রয়াধীন মন এবং মনের অধীন প্রজ্ঞা) সেই হেতু, যাহার ইন্দ্রিয় সর্ব্বপ্রকারে বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইয়াছে, তাহারই প্রজ্ঞা স্থির হইয়াছে।

যা নিশা সর্ব্বভূতানাং তস্যাং জাগর্ত্তি সংযমী।
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ।।৬৯

অর্থঃ-(৬৯) সাধারণ প্রাণিগণের পক্ষে যাহা (আত্মনিষ্ঠা) নিশাস্বরূপ, তাহাতে (আত্মনিষ্ঠাতে) সংযমী ব্যক্তি জাগ্রত থাকেন; যাহাতে (বিষয়নিষ্ঠাতে) অজ্ঞ প্রাণিসাধারণ জাগরিত থাকে, আত্মদর্শী মুনিদিগের তাহা (বিষয়নিষ্ঠা) রাত্রিস্বরূপ।

আপূর্য্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদবৎ।
তদবৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্ব্বে স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।।৭০

অর্থঃ-(৭০) যেমন নদ-নদীর জলে পরিপূরিত প্রশান্ত সমুদ্রে অপর জলরাশি আসিয়া প্রবেশ করিয়া বিলীন হইয়া যায়, সেইরূপ যে মহাত্মাতে বিষয় সকল প্রবেশ করিয়াও কোনরূপ চিত্তবিক্ষেপ উৎপন্ন করে না, তিনি শান্তিলাভ করেন; যিনি ভোগ কামনা করেন, তিনি শান্তি পান না।

বিহায় কামান্ যঃ সর্ব্বান্ পুমাংশ্চরতি নিস্পৃহঃ।
নির্ম্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি।।৭১

অর্থঃ-(৭১) যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা ত্যাগ করিয়া নিস্পৃহ হইয়া বিচরণ করেন, যিনি মমতাশূন্য ও অহঙ্কারশূন্য, তিনিই শান্তিপ্রাপ্ত হন।

এষা ব্রাহ্মী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি।
স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রহ্মনির্ব্বাণমৃচ্ছতি।।৭২

অর্থঃ-(৭২) হে পার্থ, ইহাই ব্রাহ্মীস্থিতি (ব্রহ্মজ্ঞানে অবস্থান)। এই অবস্থা প্রাপ্ত হইলে জীবের আর মোহ হয় না। মৃত্যুকালে এই অবস্থায় থাকিয়া তিনি ব্রহ্মনির্ব্বাণ বা ব্রহ্মে মিলনরূপ মোক্ষ লাভ করেন।

Saturday, August 20, 2011

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : প্রথমোহধ্যায় (শ্লোক অর্থসহ)

ওঁ নমো ভগবতে বাসুদেবায়

https://www.youtube.com/watch?v=9H-XIUq1Ldc 

ধৃতরাষ্ট্র উবাচ -
ধর্ম্মক্ষেত্রে কুরুক্ষেত্রে সমবেতা যুযুৎসবঃ।
মামকাঃ পাণ্ডবাশ্চৈব কিমকুর্ব্বত সঞ্জয়।।১

অর্থঃ-(১) ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন - হে সঞ্জয়, পুণ্যক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে আমার পুত্রগণ এবং পাণ্ডুপুত্রগণ যুদ্ধার্থে সমবেত হইয়া কি করিলেন?

সঞ্জয় উবাচ -
দৃষ্ট্বা তু পাণ্ডবানীকং ব্যূঢ়ং দুর্য্যোধনস্তদা।
আচার্য্যমুপসঙ্গম্য রাজা বচনমব্রবীৎ।।২

অর্থঃ-(২) সঞ্জয় কহিলেন - তৎকালে রাজা দুর্য্যোধন পাণ্ডব-সৈন্যদিগকে ব্যুহাকারে সজ্জিত দেখিয়া দ্রোণাচার্য্য সমীপে যাইয়া এই কথা বলিলেন।

পশ্যৈতাং পাণ্ডুপুত্রাণামাচার্য্য মহতীং চমূম্।
ব্যূঢ়াং দ্রুপদপুত্রেণ তব শিষ্যেণ ধীমতা।।৩

অর্থঃ-(৩) গুরুদেব, আপনার ধীমান্ শিষ্য দ্রুপদপুত্র কর্ত্তৃক ব্যুহবদ্ধ পাণ্ডবদিগের এই বিশাল সৈন্যদল দেখুন।

অত্র শূরা মহেষ্বাসা ভীমার্জ্জুনসমা যুধি।
যুযুধানো বিরাটশ্চ দ্রুপদশ্চ মহারথঃ।।৪
ধৃষ্টকেতুশ্চেকিতানঃ কাশীরাজশ্চ বীর্য্যবান্।
পুরুজিৎ কুন্তিভোজশ্চ শৈব্যশ্চ নরপুঙ্গবঃ।।৫
যুধামন্যুশ্চ বিক্রান্ত উত্তমৌজাশ্চ বীর্য্যবান্।
সৌভদ্রো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্ব এব মহারথাঃ।।৬

অর্থঃ-(৪-৬) এই সেনার মধ্যে ভীমার্জ্জুনের সমকক্ষ, মহাধনুর্দ্ধারী বহু বীর পুরুষ রহিয়াছেন। সাত্যকি, বিরাট, মহারথ দ্রুপদ, ধৃষ্টকেতু, চেকিতান, বীর্য্যবান্ কাশীরাজ, কুন্তীভোজ পুরুজিৎ, নরশ্রেষ্ঠ শৈব্য, বিক্রমশালী যুধামন্যু, বীর্য্যবান্ উত্তমৌজা, সুভদ্রা-পুত্র (অভিমন্যু), দ্রৌপদীর পুত্রগণ (প্রতিবিন্ধ্যাদি) ইহারা সকলেই মহারথী।

অস্মাকন্তু বিশিষ্টা যে তান্নিবোধ দ্বিজোত্তম।
নায়কা মম সৈন্যস্য সংজ্ঞার্থং তান্ ব্রবীমি তে।।৭

অর্থঃ-(৭) দে দ্বিজশ্রেষ্ঠ ! আমার সৈন্যমধ্যেও যে সকল প্রধান সেনানায়ক আছেন তাহাদিগকে অবগত হউন। আপনার সম্যক্ অবগতির জন্য তাহাদিগের নাম বলিতেছি।

ভবান্ ভীষ্মশ্চ কর্ণশ্চ কৃপশ্চ সমিতিঞ্জয়ঃ।
অশ্বত্থামা বিকর্ণশ্চ সৌমদত্তির্জয়দ্রথঃ।।৮

অর্থঃ-(৮) আপনি, ভীস্ম, কর্ণ, যুদ্ধজয়ী কৃপ, অশ্বত্থামা, বিকর্ণ, সোমদত্তপুত্র এবং জয়দ্রথঃ।

অন্যে চ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ।
নানাশস্ত্র প্রহরণাঃ সর্ব্বে যুদ্ধ-বিশারদাঃ।।৯

অর্থঃ-(৯) আমার জন্য জীবন ত্যাগে প্রস্তুত আরও অনেক নানাশস্ত্রধারী বীরপুরুষ আছেন। তাঁহার সকলেই যুদ্ধ বিশারদ।

অপর্য্যাপ্তং তদস্মাকং বলং ভীষ্মাভিরক্ষিতম্।
পর্য্যাপ্তং ত্বিদমেতেষাং বলং ভীমাভিরক্ষিতম্।১০

অর্থঃ-(১০) ভীস্মকর্ত্তৃক সম্যক্ রক্ষিত আমাদের সেনা অপরিমিত। আর ভীমকর্ত্তৃক রক্ষিত পাণ্ডবদের সেনা পরিমিত (অপেক্ষাকৃত অল্প)।

অয়নেষু চ সর্বেষু যথাভাগমবস্থিতাঃ।
ভীষ্মমেবাভিরক্ষন্তু ভবন্তঃ সর্ব্ব এব হি।।১১

অর্থঃ-(১১) আপনারা সকলেই স্ব স্ব বিভাগানুসারে সমস্ত বূহ্যদ্বারে অবস্থিত থাকিয়া ভীস্মকেই সকল দিক্ হইতে রক্ষা করিতে থাকুন।

তস্য সংজনয়ন্ হর্ষং কুরুবৃদ্ধঃ পিতামহঃ।
সিংহনাদং বিনদ্যোচ্চৈঃ শঙ্খং দধ্মৌ প্রতাপবান্।।১২

অর্থঃ-(১২) তখন প্রতাপশালী কুরুবৃদ্ধ পিতামহ ভীস্ম তাঁহার (দুর্য্যোধনের) আনন্দ উৎপাদন করিয়া উচ্চ সিংহনাদ করত শঙ্খধ্বনি করিলেন।

ততঃ শঙ্খাশ্চ ভের্য্যশ্চ পণবানকগোমুখঃ।
সহসৈবাভ্যহন্যন্ত স শব্দস্তুমুলোহভবৎ।।১৩

অর্থঃ-(১৩) তখন শঙ্খ, ভেরী, পণব, আনক, গোমুখ প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র সহসা বাদিত হইলে সেই শব্দ তুমুল হইয়া উঠিল।

ততঃ শ্বেতৈর্হয়ৈর্যুক্তে মহতি স্যন্দনে স্থিতৌ।
মাধবঃ পাণ্ডবশ্চৈব দিব্যৌ শঙ্খৌ প্রদধ্মতুঃ।।১৪

অর্থঃ-(১৪) অনন্তর শ্বেতাশ্বযুক্ত মহারথে স্থিত শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জ্জুন দিব্য শঙ্খধ্বনি করিলেন।

পাঞ্চজন্যং হৃষীকেশো দেবদত্তং ধনঞ্জয়ঃ।
পৌণ্ড্রং দধ্মৌ মহাশঙ্খং ভীমকর্ম্মা বৃকোদরঃ।।১৫
অনন্তবিজয়ং রাজা কুন্তীপুত্রো যুধিষ্ঠিরঃ।
নকুলঃ সহদেবশ্চ সুঘোষমণিপুষ্পকৌ।।১৬

অর্থঃ-(১৫-১৬) শ্রীকৃষ্ণ পাঞ্চজন্য নামে শঙ্খ, অর্জ্জুন দেবদত্ত নামক শঙ্খ এবং ভীম পৌণ্ড্র নামক মহাশঙ্খ বাজাইলেন। কুন্তীপুত্র রাজা যুধিষ্ঠির অনন্তবিজয় নামক শঙ্খ, নকুল সুঘোষ নামক শঙ্খ এবং সহদেব মণিপুস্পক নামক শঙ্খ বাজাইলেন।

কাশ্যশ্চ পরমেষ্বাসঃ শিখণ্ডী চ মহারথঃ।
ধৃষ্টদ্যুম্নো বিরাটশ্চ সাত্যকিশ্চাপরাজিতঃ।।১৭
দ্রুপদো দ্রৌপদেয়াশ্চ সর্ব্বশঃ পৃথিবীপতে।
সৌভদ্রশ্চ মহাবাহুঃ শঙ্খান্ দধ্মু পৃথক্ পৃথক্।।১৮

অর্থঃ-(১৭-১৮) হে রাজন্, মহাধনুর্দ্ধর কাশীরাজ, মহারথ শিখণ্ডী, ধৃষ্টদ্যুম্ন, বিরাট রাজা, অজেয় সাত্যকি, দ্রুপদ, দ্রৌপদীর পুত্রগণ, মহাবাহু সুভদ্রা-পুত্র - ইহারা সকলেই পৃথক্ পৃথক্ শঙ্খ বাজাইলেন।

স ঘোষো ধার্তরাষ্ট্রাণাং হৃদয়ানি ব্যদারয়ৎ।
নভশ্চ পৃথিবীঞ্চৈব তুমুলোহভ্যনুনাদয়ন্।।১৯

অর্থঃ-(১৯) সেই তুমুল শব্দ আকাশ ও পৃথিবীতে প্রতিধ্বনিত হইয়া ধৃতরাষ্ট্রপুত্রগণ ও তৎপক্ষীয়গণের হৃদয় বিদীর্ণ করিল।

অথ ব্যবস্থিতান্ দৃষ্ট্বা ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ কপিধ্বজঃ।
প্রবৃত্তে শস্ত্রসম্পাতে ধনুরুদ্যম্য পাণ্ডবঃ
হৃষীকেশং তদা বাক্যমিদমাহ মহীপতে।।২০

অর্থঃ-(২০) হে রাজন্, অনন্তর ধৃতরাষ্ট্রপক্ষীয়দিগকে যুদ্ধোদ্ যোগে অবস্থিত দেখিয়া শস্ত্রনিক্ষেপে প্রবৃত্ত কপিধ্বজ অর্জ্জুন ধনু উত্তোলন করিয়া শ্রীকৃষ্ণকে এই কথা বলিলেন।

অর্জ্জুন উবাচ -
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে রথং স্থাপয় মেহচ্যুত।।২১
যাবদেতান্ নিরীক্ষেহহং যোদ্ধু কামানবস্থিতান্।
কৈর্ময়া সহ যোদ্ধব্যমস্মিন্ রণসমুদ্যমে।।২২
যোৎস্যমানানবেক্ষেহহং য এতেহত্র সমাগতাঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রস্য দুর্বুদ্ধের্যুদ্ধে প্রিয়চিকীর্ষবঃ।।২৩

অর্থঃ-(২১, ২২, ২৩) অর্জ্জুন বলিলেন - হে অচ্যুত, যুদ্ধকামনায় অবস্থিত ইহাদিগকে যাবৎ আমি দর্শন করি, তাবৎ (তুমি) উভয় সেনার মধ্যে আমার রথ স্থাপন কর; এই যুদ্ধব্যাপারে কাহাদিগের সহিত আমার যুদ্ধ করিতে হইবে তাহা আমি দেখি; দুর্ব্বুদ্ধি দুর্য্যোধনের হিতকামনায় যাহারা এখানে উপস্থিত হইয়াছেন, সেই সকল যুদ্ধার্থিগণকে আমি দেখি।

সঞ্জয় উবাচ -
এবমুক্তো হৃষীকেশো গুড়াকেশেন ভারত।
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে স্থাপয়িত্বা রথোত্তমম্।।২৪
ভীষ্মদ্রণপ্রমুখতঃ সর্ব্বেষাঞ্চ মহীক্ষিতাম্।
উবাচ পার্থ পশ্যৈতান্ সমবেতান্ কুরূনিতি।।২৫

অর্থঃ-(২৪-২৫) সঞ্জয় কহিলেন - হে ভারত ! অর্জ্জুন কর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া শ্রীকৃষ্ণ উভয় সেনার মধ্যে ভীস্ম দ্রোণ এবং সমস্ত রাজগণের সম্মুখে উৎকৃষ্ট রথ স্থাপন করিয়া কহিলেন - "হে অর্জ্জুন, সমবেত কুরুগণকে দেখ।''

তত্রাপশ্যৎ স্থিতান্ পার্থঃ পিতৄনথ পিতামহান্।
আচার্য্যান্মাতুলান্ ভ্রাতৄ্ন্ পুত্রান্ পৌত্রান্ সখীংস্তথা।
শ্বশুরান্ সুহৃদশ্চৈব সেনয়োরুভয়োরপি।।২৬

অর্থঃ-(২৬) তখন অর্জ্জুন উভয় সেনার মধ্যেই অবস্থিত পিতৃব্যগণ, পিতামহগণ, আচার্য্যগণ, মাতুলগণ, ভ্রাতৃগণ, পুত্রগণ, পৌত্রগণ, মিত্রগণ, শ্বশুরগণ ও সুহৃদ্ গণকে দেখিলেন।

তান্ সমীক্ষ্য স কৌন্তেয়ঃ সর্ব্বান্ বন্ধূনবস্থিতান্।
কৃপয়া পরয়াবিষ্টো বিষীদন্নিদমব্রবীত্।।২৭

অর্থঃ-(২৭) সেই কুন্তীপুত্র অর্জ্জুন বন্ধুবান্ধবদিগকে যুদ্ধার্থে অবস্থিত দেখিয়া নিতান্ত করুণার্দ্র হইয়া বিষাদপূর্ব্বক এই কথা কহিলেন।

অর্জ্জুন উবাচ -
দৃষ্ট্বেমান্ স্বজনান্ কৃষ্ণ যুযুৎসূ্ন্ সমবস্থিতান্।
সীদন্তি মম গাত্রাণি মুখঞ্চ পরিশুষ্যতি।।২৮

অর্থঃ-(২৮) অর্জ্জুন কহিলেন - হে কৃষ্ণ, যুদ্ধেচ্ছু এই সকল স্বজনদিগকে সম্মুখে অবস্থিত দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইতেছে এবং মুখ শুস্ক হইতেছে।

বেপথুশ্চ শরীরে মে রোমহর্ষশ্চ জায়তে।
গাণ্ডীবং স্রংসতে হস্তাৎ ত্বক্ চৈব পরিধ্যতে।।২৯

অর্থঃ-(২৯) আমার শরীরে কম্প ও রোমাঞ্চ হইতেছে; হাত হইতে গাণ্ডীবখসিয়া পড়িতেছে এবং চর্ম জ্বালা করিতেছে।

ন চ শক্নোম্যবস্থাতুং ভ্রমতীব চ মে মনঃ।
নিমিত্তানি চ পশ্যামি বিপরীতানি কেশব।।৩০

অর্থঃ-(৩০) হে কেশব, আমি স্থির থাকিতে পারিতেছি না; আমার মন যেন ঘুরিতেছে, আমি দুর্লক্ষণ সকল দেখিতেছি।

ন চ শ্রেয়োহনুপশ্যামি হত্বা স্বজনমাহবে।
ন কাঙ্ক্ষে বিজয়ং কৃষ্ণ ন চ রাজ্যং সুখানি চ।।৩১

অর্থঃ-(৩১) যুদ্ধে স্বজনদিগকে নিহত করিয়া আমি মঙ্গল দেখিতেছি না। হে কৃষ্ণ, আমি জয়লাভ করিতে চাহি না, রাজ্যও চাহি না, সুখভোগ চাহি না।

কিং নো রাজ্যেন গোবিন্দ কিং ভোগৈর্জীবিতেন বা।
যেষামর্থে কাঙ্ক্ষিতং নো রাজ্যং ভোগাঃ সুখানি চ।।৩২
ত ইমেহবস্থিতা যুদ্ধে প্রাণাংস্ত্যক্ত্বা ধনানি চ।
আচার্য্যাঃ পিতরঃ পুত্রাস্তথৈব চ পিতামহাঃ।।৩৩
মাতুলাঃ শ্বশুরাঃ পৌত্রাঃ শ্যালাঃ সন্বন্ধিনস্তথা।
এতান্ন হন্তুমিচ্ছামি ঘ্নতোহপি মধুসূদন।।৩৪

অর্থঃ-(৩২, ৩৩, ৩৪) হে গোবিন্দ, যাহাদিগের জন্য রাজ্য, ভোগ, সুখাদি কামনা করা যায় সেই আচার্য্য, পিতৃব্য, পুত্র, পিতামহ, মাতুল, শ্বশুর, পৌত্র, শ্যালক ও কুটুম্বগণ যখন ধনপ্রাণ ত্যাগ স্বীকার করিয়াও যুদ্ধার্থে উপস্থিত, তখন আমাদের রাজ্যেই বা কি কাজ আর সুখভোগ বা জীবনেই বা কি কাজ? হে মধুসূদন, যদি ইহারা আমাকে মারিয়াও ফেলে তথাপি আমি ইগাদিগকে মারিতে ইচ্ছা করি না।

অপি ত্রৈলোক্যরাজ্যস্য হেতোঃ কিং ন্য মহীকৃতে।
নিহত্য ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ নঃ কা প্রীতিঃ স্যাজ্জনার্দ্দন।।৩৫

অর্থঃ-(৩৫) হে কৃষ্ণ, পৃথিবীর রাজত্বের কথা দূরে থাক, ত্রৈলোক্যরাজ্যের জন্যই বা দুর্য্যোধনাদিগকে বধ করলে আমাদের কি সুখ হইবে?

পাপমেবাশ্রয়েদস্মান্ হত্বৈতানাততায়িনঃ।
তস্মান্নার্হা বয়ং হন্তুং ধার্ত্তরাষ্ট্রান্ সবান্ধবান্।
স্বজনং হি কথং হত্বা সুখিনঃ স্যাম মাধব।।৩৬

অর্থঃ-(৩৬) যদিও ইহারা আততায়ী (এবং আততায়ী শাস্ত্রমতে বধ্য), তথাপি এই আচার্য্যাদি গুরুজনকে বধ করিলা আমরা পাপভাগীই হইব। অতএব আমরা সবান্ধব ধৃতরাষ্ট্রপুত্রদিগকে বধ করিতে পারি না; হে মাধব, স্বজন বধ করিয়া আমরা কি প্রকারে সুখী হইব?

যদ্যপ্যেতে ন পশ্যন্তি লোভোপহতচেতসঃ।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং মিত্রদ্রোহে চ পাতকম্।।৩৭
কথং ন জ্ঞেয়মস্মাভিঃ পাপাদস্মান্নিবর্ত্তিতুম্।
কুলক্ষয়কৃতং দোষং প্রপশ্যদ্ভির্জনার্দ্দন।।৩৮

অর্থঃ-(৩৭-৩৮) যদিও ইহারা লোভে হতজ্ঞান হইয়া কুলক্ষয়জনিত দোষ এবং মিত্রদ্রোহজনিত পাতক দেখিতেছে না, কিন্তু হে জনার্দ্দন, আমরা কূলক্ষয়জনিত দোষ দেখিয়াও সে পাপ হইতে নিবৃত্ত কেন না হইব?

কুলক্ষয়ে প্রণশ্যন্তি কুলধর্ম্মা সনাতনাঃ
ধর্ম্মে নষ্টে কুলং কৃৎস্নমধর্ম্মোহভিভবত্যুত।।৩৯

অর্থঃ-(৩৯) কূলক্ষয় হইলে সনাতন কূলধর্ম্ম নষ্ট হয় এবং ধর্ম্ম নষ্ট হইলে সমগ্র কূল অধর্ম্মে অভিভূত হয়।

অধর্মাভিভবাৎ কৃষ্ণ প্রদুষ্যন্তি কুলস্ত্রিয়ঃ।
স্ত্রীষু দুষ্টাসু বার্ষ্ণেয় জায়তে বর্ণসঙ্করঃ।।৪০

অর্থঃ-(৪০) হে কৃষ্ণ, কূল অধর্ম্মে অভিভূত হইলে কূলস্ত্রীওগণ ব্যভিচারিণী হয়। হে বার্ষ্ণেয়, কূলনারীগণ ব্যভিচারিণী হইলে বর্ণসঙ্কর জন্মে।

সঙ্করো নরকায়ৈব কুলঘ্নানাং কুলস্য চ।
পতন্তি পিতরো হ্যেষাং লুপ্তপিণ্ডোদকক্রিয়াঃ।।৪১

অর্থঃ-(৪১) বর্ণসঙ্কর, কূলনাশকারীদিগের এবং কূলের নরকের কারণ হয়। শ্রাদ্ধ-তর্পণাদি ক্রিয়ার লোপ হওয়াতে ইহাদের পিতৃপুরুষ নরকে পতিত হয় (সদ্গতিপ্রাপ্ত হয় না)।

দোষৈরেতৈঃ কুলঘ্নানাং বর্ণসঙ্করকারকৈঃ
উৎসাদ্যন্তে জাতিধর্ম্মাঃ কুলধর্ম্মাশ্চ শাশ্বতাঃ।।৪২

অর্থঃ-(৪২) কূলনাশকারীদগের বর্ণসঙ্করকারক ঐ দোষে সনাতন জাতিধর্ম্ম, কূলধর্ম ও আশ্রমধর্ম্মাদি উৎসন্ন যায়।

উৎসন্নকুলধর্ম্মাণাং মনুষ্যাণাং জনার্দ্দন।
নরকে নিয়তং বাসো ভবতীত্যনুশুশ্রুম।।৪৩

অর্থঃ-(৪৩) হে জনার্দ্ধন, যে মনুষ্যদিগের কূলধর্ম্ম উৎসন্ন যায়, তাহাদের নিয়ত নরকে বাস হয়, ইহা আমরা শুনিয়াছি।

অহোবত মহৎ পাপং কর্ত্তুং ব্যবসিতা বয়ম্।
যদ্রাজ্যসুখলোভেন হন্তুং স্বজনমুদ্যতাঃ।।৪৪

অর্থঃ-(৪৪) হায় ! আমরা রাজ্যসুখলোভে স্বজনগণকে বিনাশ করিতে উদ্যত হইয়া মহাপাপে প্রবৃত্ত হইয়াছি।

যদি মামপ্রতিকারমশস্ত্রং শস্ত্রপাণয়ঃ।
ধার্ত্তরাষ্ট্রা রণে হন্যুস্তন্মে ক্ষেমতরং ভবেত।।৪৫

অর্থঃ-(৪৫) আমি শস্ত্রত্যাগ করিয়া প্রতিকারে বিরত হইলে যদি অস্ত্রধারী দুর্য্যোধনাদি আমাকে যুদ্ধে বধ করে তাহাও আমার পক্ষে অধিকতর মঙ্গলকর হইবে।

সঞ্জয় উবাচ -
এবমুক্ত্বার্জ্জুনঃ সংখ্যে রথোপস্থ উপাবিশৎ।
বিসৃজ্য সশরং চাপং শোকসংবিগ্নমানসঃ।।৪৬

অর্থঃ-(৪৬) সঞ্জয় কহিলেন - শোকাকুলিত অর্জ্জুন এইরূপ বলিয়া যুদ্ধমধ্যে ধনুর্ব্বাণ ত্যাগ করিয়া রথোপরি উপবেশন করিলেন।

Friday, August 19, 2011

গীতা-প্রবেশিকা [ভূমিকা-২] : বৈদিক ধর্ম্মের ক্রমবিকাশ - সনাতন ধর্ম্মের বিভিন্ন অঙ্গ : (১) ঋগ্ বেদীয় ধর্ম্ম :



ঋগ্বেদই সনাতন ধর্ম্মের প্রথম গ্রন্থ। উহা প্রাচীনতম আর্য্যধর্ম্মের ও আর্য্যসভ্যতার অকৃত্রিম প্রতিচ্ছবি। উহার ঋক্ বা মন্ত্রগুলি প্রায় সমস্তই ইন্দ্র, অগ্নি, সূর্য্য, বরুণ প্রভৃতি বৈদিক দেবগণের স্তব-স্তুতিতে পূর্ণ। এই সকল মন্ত্রদ্বারা প্রাচীন আর্য্যগণ দেবগণের উদ্দেশ্যে যাগযজ্ঞ করিয়া অভীষ্ট প্রার্থনা করিতেন। কিন্তু দেবতা অনেক থাকিলেও তাঁহারা এক ঐশী শক্তিরই বিভিন্ন বিকাশ এবং ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয় - এ তত্ত্ব তখনো অবিদিত ছিল না। অনেক মন্ত্রে একথা স্পষ্টরূপেই উল্লিখিত হইয়াছে, - (১) তিনি এক ও সত্য (নিত্য), তাঁহাকেই বিপ্রগণ বিভিন্ন নাম দিয়ে থাকেন - তাঁহাকেই অগ্নি, যম, মাতরিশ্বা বলা হয়। (একংসদ্ বিপ্রা বহুধা বদন্তি' ইত্যাদি ঋক্ ১।১৬৪।৪৬)। (২) 'যিনি আমাদিগের পিতা ও জন্মদাতা, যিনি বিধাতা, যিনি বিশ্বভূবনের সকল স্থান অবগত আছেন, যিনি অনেক দেবগণের নাম ধারণ করেন কিন্তু এক ও অদ্বিতীয়, ভূবনের লোকে তাহাকে জানিতে ইচ্ছা করে' ('যো দেবানাং নামধা এক এব' ইত্যাদি ঋক্ ১০।৮২।৩)।' (৩) (ক) তখন (মূলারম্ভে) অসৎও ছিল না, সৎও ছিল না, অন্তরীক্ষ ছিল না এবং তাহার অতীত আকাশও ছিল না; কে (কাহাকে) আবরণ করিল? কোথায়? কাহার সুখের জন্য? অগাধ ও গহন জল কি তখন ছিল? (খ) তখন মৃত্যুও ছিল না, অমৃতত্ত্বও ছিল না; রাত্রি ও দিনের ভেদ ছিল না। সেই এক ও অদ্বিতীয় এক মাত্র আপন শক্তিদ্বারাই বায়ু ব্যতীত, শ্বাসোচ্ছ্বাস করিয়া স্ফূর্ত্তিমান্ ছিলেন, তাঁহা ব্যতীতি অন্য কিছু ছিল না। (নাসদাসীন্নো সদাসীৎ তদানীং' ইত্যাদি ঋক্ ১০।১২৯)।

এই শেষোদ্ধৃত অংশটা ঋগবেদীয় প্রসিদ্ধ নাসদীয় সূক্তের প্রথম দুই ঋক্। এই সূক্তের দেবতা - পরমাত্মা। সৃষ্টির পূর্ব্বে কি ছিল, এই সূক্তে ঋষি তাহারই উত্তর দিতেছেন। এই নামরূপাত্মক ব্যক্ত দৃশ্য প্রপঞ্চের অতীত এক অব্যক্ত অদ্বয় তত্ত্ব আছে যাহা হইতে এই জগৎ-প্রপঞ্চ উৎপন্ন হইয়াছে বাঁ যাহাই এই জগৎ-প্রপঞ্চরূপে অভিব্যক্ত হইয়াছে, ইহাই ঋষির বলার অভিপ্রায়। কিন্তু সে তত্ত্ব অজ্ঞেয়, অনির্ব্বাচ্য; সৎ, অসৎ, অমৃত, মর্ত্ত্য, আলো (দিবা), অন্ধকার (রাত্রি) ইত্যাদির পরস্পর দ্বৈত বাঁ কথার জুরী সৃষ্টির পরে উৎপন্ন হইয়াছে। উহার একটা বলিলেই অপরটার জ্ঞান সঙ্গে সঙ্গেই আসে। কিন্তু যখন এক ভিন্ন দুই ছিল না সেই এক অদ্বিতীয় তত্ত্ব সন্বন্ধে এই দ্বৈত ভাষার ব্যবহার করা চলে না; তাই বলা হইতেছে, সৎও নয় অসৎও নয় ইত্যাদি। সেইরূপ, জলে বাঁ আকাশে সমস্ত আবৃত ছিল ইত্যাদি যে বলা হয় তাহাও বসু আবার আকাশাদির ন্যায় জড় পদার্থ নয়, চৈতন্যময় - তাই বলা হইতেছে - 'শ্বাসোচ্ছ্বাস করিতেছেন,' কিন্তু শ্বাসোচ্ছ্বাসে বায়ুর প্রয়োজন, বায়ু ত তখন হয় নাই, তাই বলা হইতেছে, "বিনা বায়ুতে, আত্মশক্তি দ্বারা"। ঋষির অন্তর্দ্দৃষ্টি কতদূর, লক্ষ্য করুন। জগতের আদি, অব্যক্ত মূলতত্ত্বের এমন কৌশলময় গভীর মূলস্পর্শী বিচার ও বর্ণনা কোন দেশের কোন ধর্ম্মগ্রন্থে কখনও হয় নাই। আর এ বিচার, এই জ্ঞানের উদয় হইয়াছিল ভারতে কখন? - সেই সুদূর প্রাগ-ঐতিহাসিক যুগে আর্য্য সভ্যতার প্রাচীনতম অবস্থায়, যখন প্রায় সমস্ত আধুনিক সভ্যজগৎ অজ্ঞান অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল। আধুনিক পাশ্চাত্য অজ্ঞেয়বাদিগণ পর্য্যন্ত এই বৈদিক সুত্রের প্রাচীনত্ব ও ভাবগাম্ভীর্য্য চিন্তা করিয়া বিস্ময় প্রকাশ করিতেছেন। পরবর্ত্তীকালে এই তত্ত্বই উপনিষৎ সমূহে নানাভাবে বিবৃত হইয়াছে। বস্তুতঃ ঋগবেদীয় ধর্ম্ম কেবল অগ্নিতে ঘৃতাহুতি এবং নানা দেবতার নিকট গো-বৎসাদির জন্য পার্থনা - ইহাই নহে।

আমরা দেখিতেছি - (১) ঋগ্বেদীয় ঋষি জগৎ-প্রপঞ্চের অতীত অদ্বয় অব্যক্ত তত্ত্বের সন্ধান পাইয়াছিলেন। (২) সেই তত্ত্বই আবার জগতের এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বরও সৃষ্টিকর্ত্তা এবং দেবতাগণ সেই ঐশী শক্তিরই বিভিন্ন বিকাশ, ইহা জানিতেন। (৩) যজ্ঞদ্বারা দেবতা পরিতুষ্ট হইলে অভীষ্ট ফল প্রদান করেন, ইহা বিশ্বাস করিতেন এবং তদর্থে স্তব-স্তুতি সহ যজ্ঞ করিতেন। (৪) সেই সজ্ঞাদি শ্রদ্ধার সহিত সম্পন্ন হইত এবং "অর্চ্চনা" "বন্দনা" "নমস্কার" ইত্যাদি ভক্ত্যঙ্গযুক্ত ছিল। (শ্রদ্ধাং দেবা যজমানা বায়ু গোপা উপাসতে" - ঋক্ ১০।১৫১; "নমো ভরন্ত এমসি" ঋক্ ১।৭; 'দেবা বশিষ্টো অমৃতান্ ববন্দে' ঋক ১০।৬৬; "বিষ্ণবে চার্চ্চত", ইত্যাদি ঋক্)। সুতরাং সনাতন ধর্ম্মের এই প্রাচীন স্বরূপ যজ্ঞপ্রধান হইলেও জ্ঞানভক্তি-বিবর্জ্জিত ছিল না - কর্ম্ম, জ্ঞান ও উপাসনা তিনেরই উহাতে সমাবেশ ছিল।

Thursday, August 18, 2011

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : অষ্টাদশোহধ্যায় (শ্লোক)

অর্জ্জুন উবাচ -

সন্ন্যাসস্য মহাবাহো তত্ত্বমিচ্ছামি বেদিতুম্।
ত্যাগস্য চ হৃষীকেশ পৃথক্ কেশিনিসূদন।।১

শ্রীভগবানুবাচ -


কাম্যানাং কর্ম্মণাং ন্যাসং সন্ন্যাসং কবয়ো বিদুঃ।
সর্ব্বকর্ম্মফলত্যাগং প্রাহুস্ত্যাগং বিচক্ষণাঃ।।২
ত্যাজ্যং দোষবদিত্যেকে কর্ম্ম প্রাহুর্ম্মনীষিণঃ।
যজ্ঞদানতপঃকর্ম্ম ন ত্যাজ্যমিতি চাপরে।।৩
নিশ্চয়ং শৃণু মে তত্র ত্যাগে ভরতসত্তম।
ত্যাগো হি পুরুষব্যাঘ্র ত্রিবিধঃ সংপ্রকীর্ত্তিতঃ।।৪
যজ্ঞদানতপঃকর্ম্ম ন ত্যাজ্যং কার্য্যমেব তৎ।
যজ্ঞো দানং তপশ্চৈব পাবনানি মনীষিণাম্।।৫
এতান্যপি তু কর্ম্মাণি সঙ্গং ত্যক্ত্বা ফলানি চ।
কর্ত্তব্যানীতি মে পার্থ নিশ্চিতং মতমুত্তমম্।।৬
নিয়তস্য তু সন্ন্যাসঃ কর্ম্মণো নোপপদ্যতে।
মোহাৎ তস্য পরিত্যাগস্তামসঃ পরিকীর্ত্তিতঃ।।৭
দুঃখমিত্যেব যৎ কর্ম্ম কায়ক্লেশভয়াৎ ত্যজেৎ।
স কৃত্বা রাজসং ত্যাগং নৈব ত্যাগফলং লভেৎ।।৮
কার্য্যমিত্যেব যৎ কর্ম্ম নিয়তং ক্রিয়তেহর্জ্জুন।
সঙ্গং ত্যক্ত্বা ফলষ্ণৈব স ত্যাগঃ সাত্ত্বিকো মতঃ।।৯
ন দ্বেষ্ট্যকুশলং কর্ম্ম কুশলে নানুষজ্জতে।
ত্যাগী সত্ত্বসমাবিষ্টো মেধাবী ছিন্নসংশয়ঃ।।১০
নহি দেহভূতা শক্যং ত্যক্তুং কর্ম্মাণ্যশেষতঃ।
যস্তু কর্ম্মফলত্যাগী স ত্যাগীত্যভিধীয়তে।।১১
অনিষ্টমিষ্টং মিশ্রঞ্চ ত্রিবিধঃ কর্ম্মণঃ ফলম্।
ভবত্যত্যাগিনাং প্রেত্য ন তু সন্ন্যাসিনাং ক্কচিৎ।।১২
পঞ্চেমানি মহাবাহো কারণানি নিবোধ মে।
সাংখ্যে কৃতান্তে প্রোক্তানি সিদ্ধয়ে সর্ব্বকর্ম্মণাম্।।১৩
অধিষ্ঠানং তথা কর্ত্তা করণং চ পৃথগ্ বিধম্।
বিবিধাশ্চ পৃথক্ চেষ্টা দৈবঞ্চৈবাত্র পঞ্চমম্।।১৪
শরীরবাঙ্মনোভির্যৎ কর্ম্ম প্রারভতে নরঃ।
ন্যায্যং বা বিপরীতং বাঁ পঞ্চৈতে তস্য হেতবঃ।।১৫
তত্রৈবং সতি কর্ত্তারমাত্মানং কেবলন্তু যঃ।
পশ্যত্যকৃতবুদ্ধিত্বান্ন স পশ্যতি দুর্ম্মতিঃ।।১৬
যস্য নাহংকৃতো ভাবো বুদ্ধির্যস্য ন লিপ্যতে।
হত্বাপি স ইমাঁল্লোকান্ ন হন্তি ন নিবধ্যতে।।১৭
জ্ঞানং জ্ঞেয়ং পরিজ্ঞাতা ত্রিবিধা কর্ম্মচোদনা।
করণং কর্ম্ম কর্ত্তেতিত্রিবিধঃ কর্ম্মসংগ্রহঃ।।১৮
জ্ঞানং কর্ম্ম চ কর্ত্তা চ ত্রিধৈব গুণভেদতঃ।
প্রোচ্যতে গুণসংখ্যানে যথাবচ্ছৃণু তান্যপি।।১৯
সর্ব্বভূতেষু যেনৈকং ভাবমব্যয়মীক্ষতে।
অবিভক্তং বিভক্তেষু তজ্ জ্ঞানং বিদ্ধি সাত্ত্বিকম্।।২০
পৃথক্ ত্বেন তু যজ্ জ্ঞানং নানাভাবান্ পৃথগ্ বিধান্।
বেত্তি সর্ব্বেষু ভূতেষু তজ্ জ্ঞানং বিদ্ধি রাজসম্।।২১
যৎ তু কৃৎস্নবদেকস্মিন্ কার্য্যে সক্তমহৈতুকম্।
আতত্ত্বার্থবদল্পঞ্চ তং তামসমুদাহৃতম্।।২২
নিয়তং সঙ্গরহিতমরাগদ্বেষতঃ কৃতম্।
অফলপ্রেপ্সুনা কর্ম্ম যত্তং সাত্ত্বিকমুচ্যতে।।২৩
যৎ তু কামেপ্স না কর্ম্ম সাহঙ্কারেণ বা পুনঃ।
ক্রিয়তে বহুলায়াসং তদ্রাজসমুদাহৃতম্।।২৪
অনুবন্ধং ক্ষয়ং হিংসামনপেক্ষ্য চ পৌরুষম্।
মোহাদারভ্যতে কর্ম্ম যৎ তৎ তামসমুচ্যতে।।২৫
মুক্তসঙ্গোহনহংবাদী ধৃত্যুৎসাহসমন্বিতঃ।
সিদ্ধ্যসিদ্ধ্যোর্নির্ব্বিকারঃ কর্ত্তা সাত্ত্বিক উচ্যতে।।২৬
রাগী কর্ম্মফলপ্রেপ্সুর্লুব্ধো হিংসাত্মকোহশুচিঃ।
হর্ষশোকান্বিতঃ কর্ত্তা রাজসঃ পরিকীর্তিতঃ।।২৭
অযুক্তঃ প্রাকৃতঃ স্তব্ধঃশথো নৈষ্কৃতিকোহলসঃ।
বিষাদী দীর্ঘসূত্রী চ কর্ত্তা তামস উচ্যতে।।২৮
বুদ্ধের্ভেদং ধৃতেশ্চৈব গুণতস্ত্রিবিধং শৃণু।
প্রোচ্যমানমশেষেণ পৃথক্ ত্বেন ধনঞ্জয়।।২৯
প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ কার্য্যাকার্য্যে ভয়াভয়ে।
বন্ধং মোক্ষঞ্চ যা বেত্তি বুদ্ধিঃ সা পার্থ সাত্ত্বিকী।।৩০
যয়া ধর্ম্মমধর্ম্মঞ্চ কার্য্যঞ্চাকার্য্যমেব চ।
অযথাবৎ প্রজানাতি বুদ্ধিঃ সা পার্থ রাজসী।।৩১
অধর্মং ধর্মমিতি যা মন্যতে তমসাবৃতা।
সর্ব্বার্থান্ বিপরীতাংশ্চ বুদ্ধিঃ সা পার্থ তামসী।।৩২
ধৃত্যা যয়া ধারয়তে মনঃপ্রাণেন্দ্রিয়ক্রিয়াঃ।
যোগেনাব্যভিচারিণ্যা ধৃতিঃ সা পার্থ সাত্ত্বকী।।৩৩
যয়া তু ধর্ম্মকামার্থান্ ধৃত্যা ধারয়তেহর্জ্জুন।
প্রসঙ্গেন ফলাকাঙ্ক্ষী ধৃতিঃ সা পার্থ রাজসী।।৩৪
যয়া স্বপ্নং ভয়ং শোকং বিষাদং মদমেব চ।
ন বিমুঞ্চতি দুর্ম্মেধা ধৃতিঃ সা পার্থ তামসী।।৩৫
সুখং ত্বিদানীং ত্রিবিধং শৃণু মে ভরতর্ষভ।
অভ্যাসাৎ রমতে যত্র দুঃখান্তঞ্চ নিগচ্ছতি।।৩৬
যত্তদগ্রে বিষমিব পরিণামেহমৃতোপমম্।
তৎ সুখং সাত্ত্বিকং প্রোক্তমাত্মবুদ্ধিপ্রসাদজম্।।৩৭
বিষয়েন্দ্রিয়সংযোগাদ্ যত্তদগ্রেহমৃতোপমম্।
পরিণামে বিষমিব তৎসুখং রাজসং স্মৃতম্।।৩৮
যদগ্রে চানুবন্ধে চ সুখং মোহনমাত্মনঃ।
নিদ্রালস্যপ্রমাদোত্থং তৎ তামসমুদাহৃতম্।।৩৯
ন তদন্তি পৃথিব্যাং বাঁ দিবি দেবেষু বা পুনঃ।
সত্ত্বং প্রকৃতজৈর্মুক্তং যদেভিঃ স্যাত্রিভির্গুণৈঃ।।৪০
ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশাং শূদাণাঞ্চ পরন্তপ।
কর্ম্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণৈঃ।।৪১
শমো দমস্তপঃ শৌচং ক্ষান্তিরার্জ্জবমেব চ।
জ্ঞানং বিজ্ঞানমাস্তিক্যং ব্রহ্মকর্ম্ম স্বভাবজম্।।৪২
শৌর্য্যং তেজো ধৃতির্দাক্ষ্যং যুদ্ধে চাপ্যপলায়নম্।
দানমীশ্বরভাবশ্চ ক্ষাত্রং কর্ম্ম স্বভাবজম্।।৪৩
কৃষিগৌরক্ষ্যবাণিজ্যং বৈশ্যকর্ম্ম স্বভাবজম্।
পরিচর্য্যাত্মকং কর্ম্ম শূদ্রস্যাপি স্বভাবজম্।।৪৪
স্বে স্বে কর্ম্মণ্যভিরতঃ সংসিদ্ধিং লভতে নরঃ।
স্বকর্ম্মনিরতঃ সিদ্ধিং যথা বিন্দতি তচ্ছৃণু।।৪৫
যতঃ প্রবৃত্তির্ভূতানাং যেন সর্ব্বমিদং ততম্য।
স্বকর্ম্মণা তমভ্যর্চ্চা সিদ্ধিং বিন্দতি মানবঃ।।৪৬
শ্রেয়ান্ স্বধর্ম্মো বিগুণঃ পরধর্ম্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
স্বভাবনিয়তং কর্ম্ম কুর্ব্বন নাপ্নোতি কিল্বিষং।।৪৭
সহজং কর্ম্ম কৌন্তেয় সদোষমপি ন ত্যজেৎ।
সর্ব্বারম্ভা হি দোষেণ ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ।।৪৮
অসক্তবুদ্ধিঃ সর্ব্বত্র জিতাত্মা বিগতস্পৃহঃ।
নৈষ্ক্ররম্ম্যসিদ্ধিং পরমাং সন্ন্যাসেনাধিগচ্ছতি।।৪৯
ব্রহ্মভূতঃ প্রসন্নাত্মা ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি।
সমঃ সর্ব্বেষু ভূতেষু মদ্ভক্তিং লভতে পরাম্।।৫৪
ভক্ত্যা মামভিজানাতি যাবান্ যশ্চাস্মি তত্ত্বতঃ।
ততো মাং তত্ত্বতো জ্ঞাত্বা বিশতে তদনন্তরম্।।৫৫
সর্ব্বকর্মাণ্যপি সদা কুর্ব্বাণো মদ্ ব্যপাশ্রয়ঃ।
মৎপ্রসাদাদবাপ্নোতি শাশ্বতং পদমব্যয়ম্।।৫৬
চেতসা সর্ব্বকর্ম্মাণি ময়ি সংন্যস্য মৎপরঃ।
বুদ্ধিযোগমুপাশ্রিত্য মচ্চিত্তঃ সততং ভব।।৫৭
মচ্চিত্তঃ সর্ব্বদুর্গাণি মৎপ্রসাদাৎ তরিষ্যসি।
অথ চেৎ ত্বমহঙ্কারান্ন শ্রোষ্যসি বিনঙ্ক্ষ্যসি।।৫৮
যদহঙ্কারমাশ্রিত্য ন যোৎস্য ইতি মন্যসে।
মিথ্যৈষ ব্যবসায়স্তে প্রকৃতিস্ত্বাং নিয়োক্ষ্যতি।।৫৯
স্বভাবজেন কৌন্তেয় নিবদ্ধঃ স্বেন কর্ম্মণা।
কর্ত্তুং নেচ্ছসি যন্মোহাৎ করিষ্যস্যবশোহপি তৎ।।৬০
ঈশ্বরঃ সর্ব্বভূতানাং হৃদ্দেশেহর্জ্জুন তিষ্ঠতি।
ভ্রাময়ন্ সর্ব্বভূতানি যন্ত্রারূঢ়ানি মায়য়া।।৬১
তমেব শরণং গচ্ছ সর্ব্বভাবেন ভারত।
তৎপ্রসাদাৎ পরাং শান্তিং স্থানং প্রাপ্স্যসি শাশ্বতম্।।৬২
ইতি তে জ্ঞানমাখ্যাতং গুহ্যাদ্ গুহ্যতরং ময়া।
বিমৃশ্যৈতদশেষেণ যথেচ্ছসি তথা কুরু।।৬৩
সর্ব্বগুহ্যতমং ভূয়ঃ শৃণু মে পরমং বচঃ।
ইষ্টোহসি মে দৃঢ়মিতি ততো বক্ষ্যামি তে হিতম্।।৬৪
মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্ যাজী মাং নমস্কুরু।
মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োহসি মে।।৬৫
সর্ব্বধর্ম্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যো মক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।৬৬
ইদং তে নাতপস্কায় নাভক্তায় কদাচন।
ন চাশুশ্রূষবে বাচ্যং, ন চ মাং যোহভ্যসূয়তি।।৬৭
য ইদং পরমং গুহ্যং মদ্ভক্তেষ্বভিধাস্যতি।
ভক্তিং ময়ি পরাং কৃত্বা মামেবৈষ্যত্যসংশয়ঃ।।৬৮
ন চ তস্মান্মনুষ্যেষু কশ্চিন্মে প্রিয়কৃত্তমঃ।
ভবিতা ন চ মে তস্মাদন্যঃ প্রিয়তরো ভূবি।।৬৯
অধ্যেষ্যতে চ য ইমং ধর্ম্ম্যং সংবাদমাবয়োঃ।
জ্ঞানযজ্ঞেন তেনাহমিষ্টঃ স্যামিতি মে মতিঃ।।৭০
শ্রদ্ধাবাননসূয়শ্চ শৃণুয়াদপি যো নরঃ।
সোহপি মুক্তঃ শুভাল্লোঁকান্ প্রাপ্নয়াৎ পুণ্যকর্ম্মণাম্।।৭১
কচ্চিদেতৎ শ্রুতং পার্থ ত্বয়ৈকাগ্রেণ চেতসা।
কচ্চিদজ্ঞানসম্মোহং প্রনষ্টস্তে ধনঞ্জয়।।৭২

অর্জ্জুন উবাচ -

নষ্টো মোহঃ স্মৃতির্লব্ধা ত্বৎপ্রসাদান্ময়াচ্যুত।
স্থিতোহস্মি গতসন্দেহঃ করিষ্যে বচনং তব।।৭৩

সঞ্জয় উবাচ -

ইত্যহং বাসুদেবস্য পার্থস্য চ মহাত্মনঃ।
সংবাদমিমমশ্রৌষমদ্ভূতং লোমহর্ষণম্।।৭৪
ব্যাসপ্রসাদাৎ শ্রুতবানেতদ্ গুহ্যমহং পরম্।
যোগং যোগেশ্বরাৎ কৃষ্ণাৎ সাক্ষাৎ কথয়তঃ স্বয়ং।।৭৫
রাজন্ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য সংবাদমিমমদ্ভূতম্।
কেশবার্জ্জুনয়োঃ পুণ্যং হৃষ্যামি চ মুহুর্ম্মুহুঃ।।৭৬
তচ্চ সংস্মৃত্য সংস্মৃত্য রূপমত্যদ্ভূতং হরেঃ।
বিস্ময়ো মে মহান্ রাজন্ হৃষ্যামি চ পুনঃ পুনঃ।।৭৭
যত্র যোগেশ্বরঃ কৃষ্ণো যত্র পার্থো ধনুর্দ্ধরঃ।
তত্র শ্রীর্বিজয়ো ভুতির্ধ্রুবা নীতির্ম্মতির্ম্মম।।৭৮

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা : সপ্তদশোহধ্যায় (শ্লোক)




অর্জ্জুন উবাচ -

যে শাস্ত্রবিধিমুৎসৃজ্য যজন্তে শ্রদ্ধয়ান্বিতাঃ।
তেষাং নিষ্ঠা তু কা কৃষ্ণ সত্ত্বমাহো রজন্তমঃ।।১

শ্রীভগবানুবাচ -

ত্রিবিধা ভবতি শ্রদ্ধা দেহিনাং সা স্বভাবজা।
সাত্ত্বিকী রাজসী চৈব তামসী চেতি তাং শৃণু।।২
সত্ত্বানুরূপা সর্ব্বস্য শ্রদ্ধা ভবতি ভারত।
শ্রদ্ধাময়োহয়ং পুরুষো যো যচ্ছ্রদ্ধঃ স এব সঃ।।৩
যজন্তে সাত্ত্বিকা দেবান্ যক্ষরক্ষাংসি রাজসাঃ।
প্রেতান্ ভূতগণাংশ্চান্যে যজন্তে তামসা জনাঃ।।৪
অশাস্ত্রবিহিতং ঘোরং তপ্যন্তে যে তপো জনাঃ।
দম্ভাহঙ্কারসংযুক্তাঃ কামরাগবলান্বিতাঃ।।৫
কর্শয়ন্তঃ শরীরস্থং ভূতগ্রামমচেতসঃ।
মাঞ্চৈবান্তঃ শরীরস্থং তান্ বিদ্ধ্যাসুরনিশ্চয়ান্।।৬
আহারস্ত্বপি সর্ব্বস্য ত্রিবিধো ভবতি প্রিয়ঃ।
যজ্ঞস্তপস্তথা দানং তেষাং ভেদমিমং শৃণু।।৭
আয়ুঃসত্ত্ববলারোগ্যসুখপ্রীতিবিবর্দ্ধনাঃ।
রস্যাঃ স্নিগ্ধাঃ স্থিরা হৃদ্যা আহারাঃ সাত্ত্বিকপ্রিয়াঃ।।৮
কট্বম্ল-লবণাত্যুষ্ণতীক্ষ্নরুক্ষ-বিদাহিনঃ।
আহারা রাজসস্যেষ্টা দুঃখশোকাময়প্রদাঃ।।৯
যাতযামং গতরসং পূতিঃ পর্য্যুষিতঞ্চ যৎ।
উচ্ছিষ্টমপি চামেধ্যং ভোজনং তামসপ্রিয়ম্।।১০
অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যজ্ঞো বিধিদিষ্টো য ইজ্যতে।
যষ্টব্যমেবেতি মনঃ সমাধায় স সাত্ত্বিকঃ।।১১
অভিসন্ধ্যায় তু ফলং দম্ভার্থমপি চৈব যৎ।
ইজ্যতে ভরতশ্রেষ্ঠ তং যজ্ঞং বিদ্ধি রাজসম্।।১২
বিধিহীনমসৃষ্টান্নং মন্ত্রহীনমদক্ষিণম্।
শ্রদ্ধাবিরহিতং যজ্ঞং তামসং পরিচক্ষতে।।১৩
দেবদ্বিজগুরুর্প্রাজ্ঞপূজনং শৌচমার্জ্জবম্।
ব্রহ্মচর্য্যমহিংসা চ শারীরং তপ উচ্যতে।।১৪
অনুদ্ বেগকরং বাক্যং সত্যং প্রিয়হিতঞ্চ যৎ।
স্বাধ্যায়াভ্যসনং চৈব বাঙ্ ময়ং তপ উচ্যতে।।১৫
মনঃপ্রসাদঃ সৌম্যত্বং মৌনমাত্মবিনিগ্রহঃ।
ভাবসংশুদ্ধিরিত্যেতৎ তপো মানসমুচ্যতে।।১৬
শ্রদ্ধয়া পরয়া তপ্তং তপস্তৎ ত্রিবিধং নরৈঃ।
অফলাকাঙ্ক্ষিভির্যুক্তৈঃ সাত্বিকং পরিচক্ষতে।।১৭
সৎকারমানপূজার্থং তপো দম্ভেন চৈব যৎ।
ক্রিয়তে তদিহপ্রোক্তং রাজসং চলমধ্রুবম্।।১৮
মূঢ়গ্রাহেণাত্মনো যৎ পীড়য়া ক্রিয়তে তপঃ।
পরস্যোৎসাদনার্থং বা তৎ তামসমুদাহৃতম্।।১৯
দাতব্যমিতি যদ্দানং দীয়তেহনুপকারিণে।
দেশে কালে চ পাত্রে চ তদ্দানং সাত্ত্বকং স্মৃতম্।।২০
যত্তু প্রত্যুপকারার্থং ফলমুদ্দিশ্য বাঁ পুনঃ।
দীয়তে চ পরিক্লিষ্টং তদ্দানং রাজসং স্মৃতম্।।২১
অদেশকালে যদ্দানমপাত্রেভ্যশ্চ দীয়তে।
অসৎকৃতমবজ্ঞাতম্ তৎ তামসমুদাহৃতম্।।২২
ওঁ তৎসদিতি নির্দ্দেশো ব্রহ্মণস্ত্রিবিধঃ স্মৃতঃ।
ব্রাহ্মণাস্তেন বেদাশ্চ যজ্ঞাশ্চ বিহিতাঃ পুরাঃ।।২৩
তস্মাদোমিত্যুদাহৃত্য যজ্ঞদানতপঃক্রিয়াঃ।
প্রবর্ত্তন্তে বিধানোক্তাঃ সততং ব্রহ্মবাদিনাম্।।২৪
তদিত্যনভিসন্ধায় ফলং যজ্ঞতপঃক্রিয়াঃ।
দানক্রিয়াশ্চ বিবিধাঃ ক্রিয়ন্তে মোক্ষকাঙ্ক্ষিভিঃ।।২৫
সদ্ভাবে সাধুভাবে চ সদিত্যেতৎ প্রযুজ্যতে।
প্রশস্তে কর্ম্মণি তথা সচ্ছব্দঃ পার্থ যুজ্যতে।।২৬
যজ্ঞে তপসি দানে চ স্থিতিঃ সদিতি চোচ্যতে।
কর্ম্ম চৈব তদর্থীয়ং সদিত্যেবাভিধীয়তে।।২৭
অশ্রদ্ধয়া হুতং দত্তং তপস্তপ্তং কৃতঞ্চ যৎ।
অসদিত্যুচ্যতে পার্থ ন চ তৎ প্রেত্য নো ইহ।।২৮